মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : স্থাপত্য শিল্প মানবজীবনে অতি প্রয়োজনীয় একটি শিল্প। কোন মানুষই একটি বাড়ি ছাড়া স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন ও বসবাস করতে পারে না। বর্তমানে সারা বিশ্বে স্থাপত্য শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গড়ে উঠছে পর্বত সমান নানান অট্টালিকা ও সুউচ্চ স্থাপনা। এমতাবস্থায় ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে বিরাট অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ এবং এ বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য কী? তা জানা আবশ্যক। কুরআন, হাদীস ও ইমামগণের মতামত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে প্রচুর মতামত রয়েছে। স্থাপত্য শিল্পের সংজ্ঞা নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর বৈশিষ্ট্য, কাঠামো, অবস্থান, উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসলামের স্বতন্ত্র বক্তব্য। কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করে আমাদের পূর্বসূরি ইমামগণ স্থাপত্য শিল্প নির্মাণে ইসলামের বক্তব্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে স্থাপত্য শিল্পের সংজ্ঞা, ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে স্থাপত্য শিল্পের সম্পর্ক, স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, স্থাপত্য শিল্পের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়াবলি দলীলসহ আলোচনা করা হয়েছে।
স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় : স্থাপত্য একটি শিল্প, এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক না থাকলেও এর সংজ্ঞা নিয়ে স্থাপত্যবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থাপত্য শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানের সমন্বয়। স্থাপত্যকে এ কারণেই সব শিল্পকর্মের উৎস বা Mother of all arts বলা হয়েছে। ‘ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মসজিদের ইতিহাস, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৩, পৃ. ১৭।’ স্থাপত্যের সংজ্ঞায় কোন কোন ঐতিহাসিক যে কোন নির্মিত বস্তুকে স্থাপত্য বলে অভিহিত করেছেন। আবার কেউ কেউ সুদৃঢ় ও সুশোভিত প্রাসাদকে স্থাপত্য বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘ড. মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও হাফিজ মুজতাবা রিজা আহমাদ, স্থাপত্য শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশে মুসলমানদের অবদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৭ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০০৮, পৃ. ১০০।’ স্থাপত্য শিল্প বুঝাতে ইংরেজিতে Architecture পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়। যার শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ হলো, ‘ভবনের নকশা বা নির্মাণ-কৌশল বা নির্মাণ রীতি।’ ‘Zillur Rahman Siddiqui edited, Bangla Academy English-Bengali Dictonary, Dhaka : Bangla Academy, 2008, p. 37’ এ প্রক্ষিতেই ড. এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী বলেছেন, সাধারণত W. R. Lethaby বলতে আমরা মনুষ্য নির্মিত যে কোন প্রকারের স্বল্প পরিসরের কুঁড়েঘর বা প্রশস্ত অট্টালিকা বুঝি। ‘এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী, মুসলিম স্থাপত্য, রাজশাহী : ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮১, পৃ. ২।’
প্রফেসর ডব্লিউ. আর লেথাবি (ড. জ. খবঃযধনু) স্থাপত্যের সংজ্ঞায় লিখেছেন, Architecture is the practical art of building touched with emotion, not only past, but now and in the future. ‘W. R. Lethaby, Architecture, London : Macmillan and co., 1892, p. 8; উদ্ধৃত, ড. মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও হাফিজ মুজতাবা রিজা আহমাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০।’
যদিও স্থাপত্য বলতে কেবল ইমারতেকই বোঝায় না, কারণ ভূমি পরিকল্পনা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া ছাড়াও অসাধারণ ভাস্কর্য চিত্রকলা এবং বিভিন্ন ধরনের নকশা বুঝায়। ‘ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।’ কিন্তু বর্তমানে প্রবন্ধে স্থাপত্য শিল্প বলতে সাধারণভাবে বাড়িঘর, অট্টালিকা-প্রাসাদ, সুউচ্চ ও মনোরম স্থাপনাকে বুঝানো হচ্ছে। ভূমি পরিকল্পনা ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নকশাসহ স্থাপত্য শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলিকে বুঝানো হচ্ছে না।
ইসলামের জীবন দর্শন ও স্থাপত্য শিল্প : মানুষ যুুগে যুগে যেসব শিল্পের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো স্থাপত্য শিল্প। কারণ মানুষের এ পৃথিবীতে আগমনের পর হতেই শীতকালে ঠান্ডা হতে, গ্রীষ্মকালে গরম হতে, বর্ষাকালে বৃষ্টি হতে এবং রাতের অন্ধকারে পশু-প্রাণীর আক্রমণ হতে নিজেদের বাঁচাবার জন্য এ শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন উপাসনা, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বা অন্য কোন প্রয়োজনে এক স্থানে একত্রিত হবার জন্যও তাদের এই স্থাপত্য শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, মিসরী, ব্যাবিলিয়ন, গ্রিক, রোমান ও সাসানী ইত্যাদি জাতি এ শিল্পের প্রতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছিল। গ্রিক জাতি শিল্প- সংস্কৃতিতে অতি উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। তারা স্থাপত্য শিল্পেও বেশ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিল। তারা এ শিল্পের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও শৈল্পিক দিকটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিল। এ শিল্পে নির্মাণের কৌশলও তারা আবিষ্কার করেছিল। অতঃপর প্রত্যেক জাতি ও গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণ করতে থাকে। ফলে প্রত্যেক জাতির নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়েছে এবং তাতে তাদের ধর্মীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে সুস্পষ্টভাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইসলাম ধর্ম বৈরাগ্যবাদ সমর্থন করে না। কারণ নবী (সা.) বলেছেন, আমাকে বৈরাগ্যবাদ অবলম্বনের আদেশ দেয়া হয়নি। ‘ইমাম আদ-দারিমী, আস-সুনান, তাহকীক : ফাওয়ায আহমাদ যামরালী ও খালিদ আস-সাব’ আল-‘ইলমী, অধ্যায় : আন-নিকাহ, পরিচ্ছেদ : আন-নাহী ‘আনিত তাবাত্তুল, বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪০৭ হি., হাদীস নং- ২১৬৯; হাদীসটির সনদ সহীহ। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা’আরিফ, তা.বি., হাদীস নং- ৩৯৪।’
ইসলাম মুসলিমদের শিখিয়েছে যে, মানুষ চাইলে তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তার প্রতিপালকের নিকটবর্তী হতে পারে, তার সন্তুষ্টি পেতে পারে, যদি তা দীনের শিক্ষা ও বিধান অনুযায়ী আদায় করা হয়। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এবং তার সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য বৈরাগ্য সাধনের প্রয়োজন নেই। দুনিয়াদারী ছেড়ে দিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ার এবং দেহকে নানাভাবে কষ্ট দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহ কর্তৃক মানুষের জন্য প্রদত্ত কোন নিয়ামতকেও হারাম করার কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় দর্শনে দেখতে পাই যে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করতে হলে বৈরাগ্য সাধনা করতে হবে। দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে পাহাড় পর্বতে চলে যেতে হবে। সেখানে রাত দিন স্রষ্টার উপাসনায় ব্যস্ত থাকতে হবে। দুনিয়ার সমস্ত ভোগ-বিলাস ছেড়ে দিয়ে; মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার ধ্যান উপাসনায় মগ্ন থাকলেই তবে পাওয়া যাবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি। তাই এসব ধর্মে অনুসারীদের দুনিয়ার সমস্ত ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে পাহাড়ে-পর্বতে উপাসনায় ব্যস্ত হতে দেখা যায়।
উপর্যুক্ত এই দর্শনের প্রভাব আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর স্থাপত্য শিল্পেও। বিশেষত তাদের ইবাদত-বন্দেগী ও পূজার জন্য নির্মিত বাড়িঘরে। তাই আমরা মুসলিমদের মসজিদগুলো দেখতে পাই যে, তা নির্মিত হয় ভেতর-বাইরে অতি সহজভাবে এবং সাদাসিধে করে, তাদের ধর্মের শিক্ষা ও ধর্মীয় দর্শনের আলোকে। তার অভ্যন্তর ভাগে থাকে না তেমন কোন কারুকার্য, যাতে ভিতরে সালাতরত মুসলিমদের মন সে দিকে মগ্ন হয়ে না পড়ে। আর তার বাহির ভাগ নির্মিত হয় ইসলামী দর্শনের আলোকে প্রায় মিনারা বা আযানখানা সহকারে। আর তাও নির্মিত হয় জনগণের সমাবেশ স্থলে, সড়কের পাশে, বাজারে, চৌরাস্তার মোড়ে এবং এমন সব স্থানে যেখানে সহজেই পৌঁছা যায়। আর তাতে রাখা হয় সামনের বা কিবলার দিক ছাড়া বাকি তিন দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণের জানালা ও দরজা। যাতে তাতে প্রচুর পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। অতএব, মুসলিমরা তাদের দুনিয়াবী কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় এবং দুনিয়াবী কর্মকাণ্ড একই সাথে তাদের প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ মতে আদায় করে তার নৈকট্য লাভ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার। ‘আল-কুরআন, ৬২ : ১০।’
অন্যদিকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মন্দির, মঠ ও গির্জাগুলো নির্মাণ করে পাহাড়ের চূড়ায়, জঙ্গলে এবং লোকালয় থেকে বহু দূরে। আর যদি লোকালয়ের মধ্যে নির্মাণ করা হয়; তবে তার স্থাপত্য রীতিটি করা হয় প্রায় অন্ধকার করে, যাতে মানবসমাজ থেকে অন্তত রূপকভাবে হলেও দূরে অবস্থান করে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থেকে তাতে একান্ত মনে উপাসনায় নিয়োজিত হওয়া যায়। এভাবেই হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা যেমন তাদের স্থাপত্য শিল্পগুলো তাদের ধর্মীয় দর্শনের আলোকে তৈরি করেছে, তেমনিভাবে মুসলিমরাও তাদের ধর্মীয় দর্শন অনুযায়ী তাদের ধর্মীয় ইবাদতের স্থান মসজিদগুলোর স্থাপত্য রীতি আলাদা করে নিয়েছে। ফলে তাদের নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়েছে। ‘সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পবোধ, ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৮৩ খ্রি., পৃ. ১৩৯।’
আমরা যদি প্রাচীন মিসরীয় স্থাপত্য শিল্পগুলো দেখি তার সাথে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের তুলনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, এতদুভয়ের নির্মাণ কৌশলে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। প্রথমোক্তদের স্থাপত্য শিল্পগুলো যেমন আকারে বড়, তেমনি শক্ত মজবুতও বটে। তা থেকেই বুঝা যায় যে, তারা একটি ধর্মে দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের জীবনযাপন রীতি থেকে মনে হয়, তারা এ জীবনের পরে আরো একটি জীবনে বিশ্বাসী ছিল। অন্যদিকে গ্রিক জাতির স্থাপত্য শিল্পের দিকে তাকালে মনে হয়, তারা তা অতি সূক্ষ্মভাবে সুন্দর ও সুনিপুণভাবে তৈরি করেছে। কারণ তারা কেবল দুনিয়ার এ জীবনেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের জীবনযাপন রীতিতে যুক্তির প্রখরতা ও বস্তবাদী দর্শনের প্রতিফলন হয়েছে। ‘ড. হামদি কোমাইস, আত্তাযাওয়াক আল ফান্নি ওয়া দাওরুল ফান্নান ওয়াল মুস্তামতে, আল-হাইয়্যাতুল ‘আম্মা লি শুয়ুনুল মাতাবে আল আছারিয়া, তা. বি., পৃ. ৬৭।’
মোটকথা হলো, যে কোন জাতির স্থাপত্য শিল্পে তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তেমনিভাবে শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও চিন্তা ভাবনার প্রতিফলনও ঘটে। আর যে যুগে তা নির্মিত হয়েছে সে যুগের মন মানসিকতা চিন্তাভাবনাও তাতে সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক যুগের আলাদা বিশেষ স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়। তাতে তাদের চিন্তা দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অর্থনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটে এবং তাদের জীবনবোধ ও সৌন্দর্যবোধ প্রতিভাত হয়।
স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি : স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক; নেতিবাচক নয়। ইসলাম মুসলিমদের স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের অনুমোদন দেয়। তাতে শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর অনুমোদনও দেয়। বাড়িঘর এবং অট্টালিকা কারুকার্যময় করার অনুমতিও দেয়। তবে তা সবই হতে হবে অহঙ্কার প্রকাশ না করার ও বিলাসিতা প্রকাশ না করার শর্তে এবং অপব্যয় ব্যতিরেকে। আল কুরআন এবং মহানবীর হাদীসে এর প্রতি বারবার ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল-কুরআনে ‘হুসুন’ ‘আল-কুরআন, ৫৯ : ২’ বা কিল্লা, সায়াসি ‘আল-কুরআন, ৩৩ : ২৬’ বা দুর্গ, বুরুজ ‘আল-কুরআন, ৮৫ : ১’ বা উচ্চ অট্টালিকা ও দুর্গ, কুসুর ‘আল-কুরআন, ৭ : ৭৪’ বা অট্টালিকা, গুরুফ, ‘আল-কুরআন, ২৫ : ৭৫’ বা কক্ষ, জুদুর ‘আল-কুরআন, ৫৯ : ১৪’ বা দেয়াল, র্সাহ ‘আল-কুরআন, ২৭ : ৪৪’ বা প্রাসাদ, কুরা মুহাস্সানা ‘আল-কুরআন, ৫৯ : ১৪’ বা ‘সুরক্ষিত জনপদ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। ‘ড. হাসান আল বাশার, মাদখাল ইলাল আসার আল ইসলামিয়া, কাহেরা : দারুণ নাহদা, ১৯৯৬ খ্রি., পৃ. ২১’ যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। ‘আল-কুরআন, ৪ : ৭৮।’
অর্থাৎ তোমরা সৃদুঢ় উচ্চ দুর্গে অবস্থান করলেও তোমাদের মৃত্যু অবশ্যই আসবে। তোমরা মৃত্যু থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না, পালাতে পারবে না। এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, সুদৃঢ় উচ্চ দুর্গ ও অট্টালিকা নির্মাণ করা ও তাতে বসবাস করা বৈধ।
আল্লাহ তায়ালা অপর এক আয়াতে বলেন, তাকে বলা হলো, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর’। অতঃপর যখন সে তা দেখল, সে তাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং তার পায়ের নলাদ্বয় অনাবৃত করল। সুলাইমান বললেন, ‘এটি আসলে স্বচ্ছ কাঁচ-নির্মিত প্রাসাদ। ‘আল-কুরআন, ২৭ : ৪৪’। এ আয়াতটিও প্রমাণ করে যে, অতি উচ্চমানের শিল্পসম্মত সুরম্য বাড়ি ও প্রাসাদ নির্মাণ করা বৈধ। কারণ সুলাইমান আ. একটি স্বচ্ছ কাঁচের উচ্চমানের শিল্পসম্মত প্রাসাদ নির্মাণ করে তার তলদেশ দিয়ে পানি প্রবাহিত করেন। তা এমন সুকৌশলে নির্মাণ করেন যে, যারা এর সম্পর্কে অবগত নয়, তারা মনে করে যে, তা পানি। অথচ পানি এবং পথচারীর মধ্যে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ রয়েছে। ফলে তার পায়ে পানি লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। এ থেকে বুঝা যায় যে, সুলাইমান আ. নির্মিত এ প্রাসাদটিতে অতি উচ্চমানের শিল্প নৈপুণ্যের সমাবেশ ঘটেছিল। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, এ জাতীয় শিল্পমানের প্রাসাদ তৈরি করা এবং প্রাসাদকে কারুকার্যময় করা, তাতে বসবাস করা ইসলামে বৈধ।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, আর স্মরণ কর, যখন আদ জাতির পর তিনি তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করলেন এবং তোমাদের জমিনে আবাস দিলেন। তোমরা তার সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করছ এবং পাহাড় কেটে বাড়ি বানাচ্ছ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহকে স্মরণ কর এবং জমিনে ফাসাদকারীরূপে ঘুরে বেড়িয়ো না। ‘আল-কুরআন, ৭ : ৭৪।’
উপর্যুক্ত আয়াতে ‘তোমরা তার সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করছ এবং পাহাড় কেটে বাড়ি বানাচ্ছ’ একথা বলার পর ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহকে স্মরণ কর’ এ কথা বলা থেকে বুঝা যায়, প্রাসাদ আল্লাহ তায়ালার একটি বড় নিয়ামত। প্রাসাদ তৈরি করা বৈধ না হলে তাকে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করা হতো না।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর হাদীসে মুমিনদের এমন একটি অট্টালিকার সাথে তুলনা করেছেন, যার একটি অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। তিনি বলেন, নিশ্চয় এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য অট্টালিকাস্বরূপ; যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। ‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-মাসাজিদ, পরিচ্ছেদ : তাশবীকুল আসাবি ‘ফিল মাসজিদ ওয়া গায়রিহী, বৈরূত : দারু ইবনি কাছীর, ১৪০৭ হি./ ১৯৮৭ খ্রি., হাদীস নং- ৪৬৭।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনিসহ সকল নবী-রাসূলকে একটি সুউচ্চ ও সুন্দর অট্টালিকার সাথে তুলনা করে বলেন, তারা বললো, এ প্রাসাদের নির্মাণ কৌশল কতোই না চমৎকার হতো, যদি তাতে এই ইটটি বসানো হতো! ‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, বৈরূত : মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./ ১৯৯৯ খ্রি., খ. ১৫, পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৯৩৩৭; হাদীসটির সনদ সহীহ।’
অট্টালিকা নির্মাণ বৈধ না হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো নবী-রাসূলগণকে এবং মুসলিমদের অবৈধ ও হারাম একটি জিনিসের সাথে তুলনা করতেন বলে মনে হয় না। ইসলামী শিল্পকলার কিছু কিছু পাঠক মনে করেন, বাড়িঘর ইত্যাদি সুনিপুণভাবে নির্মাণ করা, কারুকার্যময় করা, উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করা ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ ইসলাম দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতাকে অপছন্দ করে। ইসলাম মুসলিমদের ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত হতে আহ্বান জানায়। কাজেই ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘরবাড়ি তৈরি এবং তাতে কারুকার্য করতে নিষেধ করে।
ইমাম কুরতুরী (রহ.) বলেন, উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ অনেকেই মাকরূহ বলে মনে করেন। এ মত পোষণকারীগণের মধ্যে বিশিষ্ট তাবিঈ আল-হাসান আল-বাসরী (২১-১১০ হি.) (রহ.) অন্যতম। ‘ইমাম কুরতুরী, আল-জামিলি-আহকামিল কুরআন, প্রাগুক্ত, খ. ৭, পৃ. ২৩৯-২৪০।’ তাঁরা নবী (সা.) এর নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ কোন বান্দাহকে অপদস্ত করতে চাইলে তখন তার সম্পদ বাড়িঘর, পানি ও মাটিতে ব্যয় করেন। ‘ইমাম বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান, বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হি., হাদীস নং- ১০৭২০; হাদীসটির সনদ যঈফ (দুর্বল); আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযু’আহ ওয়া আছারুহাস সায়্যি ফিল উম্মাহ, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা’আরিফ, তা.বি., হাদীস নং- ২২৯৫।’
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি নির্মাণ করবে, কিয়ামত দিবসে সে তা তার ঘরের ওপর বহন করে নিয়ে আসবে। ‘ইমাম তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, মাওসিল : মাকতাবাতুল উলুমি ওয়াল হিকাম, ১৪০৪ হি./ ১৯৮৩ খ্রি., হাদীস নং- ১০২৮৭; হাদীসটির সনদ খুবই দুর্বল; আল-আলবানী, যঈফুত তারগীব ওয়াল তারহীব, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা’আরিফ, তা. বি., হাদীস নং- ১১৭৬।’ ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, এটা আমারও অভিমত। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুমিন যে অর্থই ব্যয় করে তার জন্য সে আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান পাবে। তবে বাড়িঘর নির্মাণের জন্য যা ব্যয় করে বা আল্লাহর নাফরমানী করতে গিয়ে যা ব্যয় করে তার জন্য সে কোন উত্তম প্রতিদান পাবে না। ‘ইমাম দারা কুতনী, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-বুয়ু’, বৈরূত : দারুল মা’রিফাহ, ১৩৮৬ হি./ ১৯৬৬ খ্রি., হাদীস নং- ১০১; হাদীসটির সনদ যঈফ (দুর্বল); আল-আলবানী, সিলতিলাতুল আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযু’আহ ওয়া আছারুহাস সায়্যি ফিল উম্মাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৮৯৮।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, আদম সন্তানের জন্য কেবল এ জিনিসগুলো ছাড়া অন্য কিছু পাওয়ার হক নেই, বসবাসের জন্য একটি বাড়ি, সতর ঢাকার জন্য একটি পোশাক এবং রুটির টুকরা ও পানি। ‘ইমাম তিরমিযী, আল-জামি’, তাহকীক : আহমাদ মুহাম্মদ শাকির ও অন্যান্য, অধ্যায় : আয-যুহদ, পরিচ্ছেদ : আয-য়িহাদাহ ফিদ্দুনয়া, বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছির আরাবী, তা. বি., হাদীস নং- ২৩৪১। হাদীসটির সনদ মুনকার; আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযু’আহ ওয়া আছারুহাস সায়্যি ফিল উম্মাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ১০৬৩।’
কাইস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা খাব্বাব ইবনুল আরত ((রা.))-এর কাছে তাকে অসুখের সময় দেখতে গেলাম। তখন দেখলাম যে, তিনি তার একটি দেয়াল তৈরি করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘মুসলিমকে সব কাজের জন্য প্রতিদান দেয়া হবে, কেবল এ মাটিতে যা করে তা ব্যতীত।’ ইতিমধ্যে তার পেটে সাতবার আগুনের ছ্যাঁকা (থেরাপি) দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বললেন, যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মৃত্যুর জন্য দুয়া করতে নিষেধ না করতেন, তবে আমি মৃত্যুর জন্য দুয়া করতাম। (অপর বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে) তারপর বলেন, আমাদের যেসব বন্ধু মারা গেছেন তাদের দুনিয়ার কোন কিছু তাদের ক্ষতি করতে পারেনি। আমরা তাদের পরে এমন কিছু পেয়েছি যা রাখার জন্য এ মাটি ছাড়া আর কিছু পাই না। ‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-মারযা, পরিচ্ছেদ : তামান্নাল মারীযি বিল-মাওতি, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৪৬৭।’
আনাস ((রা.)) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সব খরচ আল্লাহর পথে খরচ বলে গণ্য হবে কেবল বাড়ির জন্য খরচ ব্যতীত। তাতে কোন কল্যাণ নেই। ‘ইমাম তিরমিযী, আল-জামি’, অধ্যায় : সিফাতুল কিয়ামাহ ওয়ার রাকায়িক ওয়ার ওরা’, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ২৩৪১; হাদীসটির সনদ যঈফ।’
আব্দুল্লাহ ইবন ওমর ((রা.)) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা বাড়িঘর নির্মাণে হারাম থেকে বিরত থাকো। কারণ তা সর্বনাশের মূল ভিত্তি। ‘ইমাম বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ১০৭২২; আল্লামা মুনাবী আল-জামিউস সাগীরের শরাহয় বলেন, ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়। খ. ১, পৃ. ৫৭।’ ইবন হাজার আল আসকালানী (রহ.) বলেন, যে সব বাড়িঘর বসবাসের জন্য প্রয়োজন নয়, যা মানুষকে ঠান্ডা গরম থেকে বাঁচায় না, সে সব বাড়িঘরের ক্ষেত্রেই হাদীসগুলোর উর্পযুক্ত বক্তব্যগুলো প্রযোজ্য। আনাস ((রা.)) থেকে একটি মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘সব বাড়িঘর তার মালিকের জন্য ক্ষতিকর বলে পরিগণিত হবে, তবে যা তার বসবাসের জন্য আবশ্যক তা ব্যতীত।
তিনি আরো বলেন, দাউদীর কথা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সব রকমের বাড়িঘর নির্মাণ করা পাপ। আসলে ব্যাপার কিন্তু তা নয়। বরং এক্ষেত্রে কিছু বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যেসব বাড়িঘর প্রয়োজনের অতিরিক্ত, তা সবই নির্মাণ করা পাপ নয়। বরং এরূপ কিছু কিছু বাড়িঘর নির্মাণ করা ছাওয়াবের কাজ। যেমন যে বাড়িঘর দ্বারা নির্মাতা ছাড়া অন্যরাও উপকৃত হয় তা দ্বারা নির্মাতা ছাওয়াব পাবেন। আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। ‘ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী, প্রাগুক্ত, খ. ১১, পৃ. ৯৩।’
শেখ আব্দুর রহমান আল-বান্না এসব হাদীসের ওপর টীকা লিখতে গিয়ে বলেন, ‘এই অভিসম্পাত তাদের ওপর অর্পিত হবে যারা দুনিয়াতে চিরস্থায়ীভাবে থাকার আশায় বা অহঙ্কার প্রকাশের জন্য বা গরিব-দুঃখী মানুষের সামনে বড় লোক বলে জাহির করার জন্য বা যারা দুনিয়াতে চিরদিন থাকার চেষ্টা করে, তাদের সাদৃশ্য ধারণের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করে তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। যারা এরূপ করে তাদের নিন্দা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমরা সুদৃঢ় প্রাসাদ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা স্থায়ী হবে।’ ‘আল-কুরআন, ২৬ : ১২৯।’
শেখ মুহাম্মদ আল-গাযালী বলেন, ‘যদি এসব হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা হতো; তাহলে কোন শহর-নগর ও গ্রাম গড়ে উঠত না। মানুষ ঝুপড়িতেই বসবাস করত। যেখানে তারা বিনা কষ্টে সতর ঢাকতে পারত না। সত্য কথা হলো: এসব হাদীস যারা নিজেদের ধনী হিসেবে প্রকাশের জন্য বা গর্ব-অহঙ্কার প্রকাশের জন্য বা বড়লোক বলে জাহির করার জন্য বাড়িঘর করে তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিঃসন্দেহে অট্টালিকা নির্মাণ বৈধ। ‘সায়্যিদ সাবিক, দাওয়াতুল ইসলাম, বৈরূত : দারুল ফিকর, তা. বি., পৃ. ৩৬।’
অতএব, উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ ও তা কারুকার্যময় করা এবং তার সৌন্দর্য দেখে আনন্দ উপভোগ করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ নয়; বৈধ। বরং তা কাক্সিক্ষত বিষয়ে পরিণত হয়, যদি অহঙ্কার প্রকাশ বা নিজেকে বড়লোক বলে জাহির না করে নির্মাণ করা হয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো কোনো সাহাবীও বিনা দ্বিধায় অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস ((রা.)) বসরায় একটি অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন। সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস ((রা.)) বসরার গভর্নর ছিলেন। তিনি এ অট্টালিকা নির্মাণের পর বলেন, এ অট্টালিকা তো লোকদের আমার নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! এ সংবাদ ওমর (রা.) শুনার পর তিনি মুহাম্মদ ইবন মাসলামাকে বসরায় পাঠান এবং তাকে আদেশ দেন, যেন তিনি বসরায় পৌঁছে বাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেন। তখন তিনি বসরা গিয়ে বাড়িটি আগুন লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। আল্লামা ইবন তাইমিয়ার মতে, ওমর (রা.) এ কাজটি করেছিলেন অট্টালিকা তৈরি ইসলামে নিষিদ্ধ বলে নয়, বরং তিনি তা করেছিলেন একজন গভর্নর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন বলেই। কারণ তিনি চাননি তার কোন গভর্নর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা না দেখে দায়িত্ব পালন করুক। ‘ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়া আল কুবরা, বৈরূত : দারুল মা’রিফাহ, ১৩৮৬ হি., মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়া, খ. ৫, পৃ. ১১৮।’ সাহাবীদের পরে তাবিয়ী, তাবে-তাবিয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে এব তার পরবর্তী যুুগেও মুসলিমরা পৃথিবীর সর্বত্র নির্দ্বিধায় অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। দুর্গ গড়ে তুলেছেন।
আমি মনে করি, কেবল নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য বহুতল অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরূহ থেকে মুক্ত নয়। তবে ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে ভাড়া দিয়ে অর্থ রোজগার করার জন্য অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করা মাকরূহ নয়। বরং তা ছাওয়াবের কাজও হতে পারে, যদি মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান কল্পে তা তৈরি করা হয়। বিশেষত তা যদি বড় বড় শহরগুলোতে তৈরি করা হয়। কারণ বর্তমান যুগে আমাদের এই ঢাকা শহরের মত শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা না হলে; আরো দু চার দশটি ঢাকা শহরের মতো শহরের প্রয়োজন হবে। তখন দেখা দিবে তীব্র ভূমি সংকট। ইসলাম এমন কোন সিদ্ধান্ত দেয় না, যা মানুষের সমস্যা বাড়ায়। ইসলাম এসেছে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য, সমস্যা বাড়াবার জন্য নয়। এ কারণেই ফকীহগণ বলেছেন, ‘যেখানেই মানব কল্যাণ সেখানেই ইসলাম’।
স্থাপত্য শিল্পের প্রতি ইসলামের দিকনির্দেশনা : ইসলামী গবেষকগণ স্থাপত্য শিল্প নির্মাণে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে যে সব মূলনীতি অবলম্বন করে স্থাপত্য শিল্প নির্মিত হওয়া আবশ্যক তার বিবরণও দিয়েছেন। আমরা এখানে পাঠকদের সামনে তা পেশ করছি :
স্থাপত্য শিল্প নির্র্মাণে ইসলামের নির্দেশিত সীমারেখা ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মসজিদ নির্মাণের সময় অবশ্যই নবী (সা.) কর্তৃক মাসজিদে নববী তৈরিকালে নির্ধারিত বিশেষ শিল্পরূপটির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। তাকে প্রায় চতুর্ভূজাকৃতি বিশিষ্ট করে ভেতরে-বাইরে একেবারে সাদাসিধে করে তৈরি করতে হবে। কিবলা ছাড়া বাকি তিন দিকে দরজা জানালা রাখা যাবে। এটাই হলো ইসলামের দৃষ্টিতে মসজিদের স্থাপত্য রীতি।
বারেতা আলম আল-ইসলামী মসজিদের ডিজাইনে তার স্থাপত্য রীতি ও রূপরেখা অক্ষুণ্ন রাখা আবশ্যক বলে মনে করে। এ কারণেই তারা গোটা বিশ্বের মুসলিমদের মসজিদের স্থাপত্য রীতি ও রূপরেখা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে আমরা রাবেতার উপদেশাবলি পেশ করছি:
মসজিদকে মুসলিম সমাজের প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে হবে। কেননা ইসলামে সমাজের সকল জনহিতকর কার্যক্রম ধর্মীয় কর্তব্যের শামিল। কাজেই মসজিদের জন্য নির্বাচিত স্থানটি হবে একেবারে শহরের মধ্যে বা এমন উন্মুক্ত স্থানে যেখানে সকলেই সহজে যাতায়াত করতে পারে। তা শহরেই হোক কিংবা গ্রামে বা মহল্লায় বা কর্মস্থলে হোক।
মসজিদ সাদাসিধেভাবে তৈরি করতে হবে। যে পরিবেশে তা তৈরি করা হচ্ছে তার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। অবশ্য স্থাপত্য রীতিতে আধুনিক কলা কৌশলের ব্যবহার করা যাবে। যেমন- ক) সালাতের স্থানটি এমন স্বাস্থ্যকর হতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো বাতাস থাকে এবং অতিরিক্ত ঠাণ্ডাও না হয়; আবার অতিরিক্ত গরমও না হয়। খ) মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে সালাত আদায়ের জন্য রাখা যাবে, যেখানে তারা পুরুষদের সাথে মেলামেশা না করে যাতায়াত করতে পারে। গ) মসজিদে সালাতের স্থান ছাড়াও একটি লাইব্রেরি, আর তাতে বসে লেখাপড়া করার মতো স্থান এবং একটি মিলনায়তন বা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করার জন্য হলঘর রাখা যাবে। ঘ) মসজিদের পাশে সালাতের সময় ছাড়া অন্য সময়, বিশেষত শীত-গ্রীষ্মের ছুটির সময় যাতে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে, আনন্দ-বিনোদন করতে পারে সেজন্য খেলার মাঠ থাকতে পারে। ঙ) মেয়েদের ঘর রান্নার কাজ শেখাবার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ রাখা যাবে। চ) মসজিদের সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা দানের জন্য একটি ডিস্পেনসারী রাখা যাবে। মৃত মানুষদের গোসল দান ও কাফন পরাবার জন্য একটি আলাদা কক্ষ রাখা যাবে। ছ) মসজিদ নির্মাণের সময় এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে, যেখানে মসজিদের সম্মান রক্ষা করা যায়। সুতরাং তা সিনেমা হল বা ক্লাব ইত্যাদির পাশে নির্মাণ করা ঠিক হবে না; যেখানে মসজিদের সম্মান রক্ষা করা যাবে না। জ) মসজিদের পাশে মসজিদসংলগ্ন মুসাফিরখানা থাকতে পারে, যেখানে বিদেশী মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা ও মেহমানদারী করার ব্যবস্থা থাকবে।
পর্দার ব্যবস্থা থাকা : ইসলামের দৃষ্টিতে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের সময় যেসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় তার অর একটি হলো বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে মুসলিমদের পর্দা রক্ষা করা সহজতর হয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের সতর ঢাকতে ও পর্দা করতে আদেশ দিয়েছেন। মানুষের নজরের বাইরে থাকতে বলেছেন। অন্যের বাড়িঘর পূর্বানুমতি না নিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য কারও গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নিবে এবং গৃহবাসীদের সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। অতঃপর যদি তোমরা সেখানে কাউকে না পাও তাহলে তোমাদের অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি তোমাদের বলা হয়, ‘ফিরে যাও’ তাহলে ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য অধিক পবিত্র। তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। যে ঘরে কেউ বাস করে না, তাতে তোমাদের কোন ভোগসামগ্রী থাকলে, সেখানে তোমাদের প্রবেশে কোন পাপ হবে না। আর আল্লাহ জানেন যা তোমরা প্রকাশ কর আর যা তোমরা গোপন কর। ‘আল-কুরআন, ২৪ : ২৭-২৯।’ বুখারীর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কেউ তোমার বাড়ির অভ্যন্তরে তোমার অনুমতি বিহীন চোখ দেয়; আর তুমি তাকে পাথর নিক্ষেপ করে তার চোখ কানা করে দাও; তাহলে তোমার কোন দোষ হবে না। ‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আদ-দিয়াত, পরিচ্ছেদ : মান আখাযা হাক্কাহু আও ইকতসসা দুনাস সুলতানি, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৬৪৯৩।’ এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, অন্যের বাড়ির অভ্যন্তরে তার অনুমতি ছাড়া দৃষ্টি দেয়া অপরাধ। তেমনিভাবে এ হাদীস থেকে এটাও বুঝা যায় যে, বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করা যে, বাহির থেকেই তার অভ্যন্তরের সবকিছু এমনিতেই দেখা যায়, তাও অপরাধ।
প্রশস্ত করে তৈরি করা : বাড়িঘর নির্মাণের সময় তৃতীয় যে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে তা হচ্ছে প্রশস্ত করে তৈরি করা। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) চাইতেন তার বাড়ি ঘর প্রশস্ত হোক। তিনি বাড়িঘর প্রশস্ত হওয়াকে সৌভাগ্য বলেও মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চারটি জিনিস সৌভাগ্যের প্রতীক, সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকম, প্রশস্ত বাড়ি-ঘর, সৎ প্রতিবেশী এবং ধৈর্যশীল বাহন। ‘ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ, অধ্যায় : আন-নিকাহ, বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খ্রি., হাদীস নং- ৪০৩২। হাদীসটি সাহীহ। দ্র. আল-আলবানী, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ, হাদীস নং- ২৮২।’ তিনি প্রায় সময় এ দুয়াটি পড়তেন, হে আল্লাহ! আমার পাপ ক্ষমা করে দিন, আমার বাড়িঘর প্রশস্ত করে দিন, আর আমার রিযকে বরকত দিন।
এ দুয়া শুনে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর! রাসূল, আপনি এ দুয়াটি কত বেশিই না করেন? তখন তিনি বললেন, কল্যাণের আর কিছু চাইতে বাকি আছে কি? ‘ইমাম নাসায়ী, আস-সুনান, তাহকীক : আবুল ফাতাহ আবু গুদ্দাহ, অধ্যায় : ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লাহ, পরিচ্ছেদ : মা ইয়াকুলু ইযা তাওয়ায্যাআ, হালব : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি., হাদীস নং- ৯৯০৮। মুহাম্মদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী হাদীসটি দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। আল-আলবানী, গায়াতুল মারামি ফী তাখরীজি আহাদীছিল হালালি ওয়াল হারাম, বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি., পৃ. ৮৭, হাদীস নং- ১১২।’
বসবাসকারীর মনস্তুষ্টি : স্থাপত্য শিল্পের প্রতি ইসলাম যে সব নির্দেশনা দেয়, তার মধ্যে আর একটি হলো বসবাসকারীর মনস্তুষ্টি অর্জিত হওয়া। অর্থাৎ বাড়ি-ঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বসবাসকারী সেখানে মানসিক প্রশাস্তি লাভ করে বাস করতে পারে। সে সেখানে সামাজিক নানা বাধা অতিক্রম করে মুক্ত হয়ে তার একান্ততা (privacy) ও স্বাধীনতা রক্ষা করে বসবাস করতে পারে, শান্তি পায় এবং আরামে জীবনযাপন করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রতি তার করুণা ও দয়ার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য শান্তির আবাস বানিয়েছেন। ‘আল-কুরআন, ১৬ : ৮০।’
উপর্যুক্ত আয়াতের ‘সাকান’ শব্দটি ‘সাকুনা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ সান্ত¡না ও প্রশান্তি অর্থাৎ বাড়িঘরকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের শান্তির নীড় হিসেবে বানিয়েছেন। যাতে আমরা সেখানে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। সুতরাং বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে সেখানে শান্তির সাথে বসবাস করা যায়।
সাদাসিধে ও বিলাসিতামুক্তভাবে তৈরি করা : বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি হতে হবে, যাতে তা সাদাসিধে ও বিলাসিতামুক্ত হয়। কারণ ইসলাম মুসলিমদের সব ক্ষেত্রে সাদাসিধে বিলাসিতাহীন জীবনযাপন করতে উৎসাহিত করে। এই সিলাসিতা মুক্ত জীবনযাপনের মধ্যে আছে বাড়িঘর বিলাসিতামুক্ত সাদাসিধেভাবে তৈরি করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে বনী আদম! তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের সুজর পরিচ্ছেদ পরিধান কর এবং খাও, পান কর কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। ‘আল-কুরআন, ৭ : ৩১।’ অপচয় বলতে বুঝানো হয়, আল্লাহ যেখানে অর্থ ব্যয় করা হারাম করেছেন সেখানে অর্থ ব্যয় করা এবং এমন সব কাজে অর্থ ব্যয় করা যা বিলাসিতা ও অপ্রয়োজনীয় বলে পরিগণিত হয়। ইসলাম সব ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সুবিচার কামনা করে। তাই ইসলাম অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ন্যায়সঙ্গতভাবে অর্থ ব্যয় করা পছন্দ করে। সুতরাং বাড়িঘর তৈরিতে ন্যায়ানুগতভাবে কারুকার্য করাও ইসলাম অনুমোদন করে; তবে তা হতে হবে অবশ্যই বিলাসিতা পরিহার করে ন্যায়পরায়ণতার সীমারেখার মধ্যে।
মজবুত ও সুন্দর করা : ইসলাম মুসলিম স্থপতির কাছে দক্ষতার সাথে উৎকর্ষের সাথে মজবুত ও সুন্দর করে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণ করা কামনা করে। কারণ রাসূসুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে বলেছেন, তোমরা কেউ কোন কাজ করলে সে তা উৎকর্ষ ও দক্ষতার সাথে করুক তা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। ‘ইমাম আবু ইয়ালা আল-মাওসিলী, আল-মুসনাদ, তাহকীক : হুসাইন সালীম আসাদ, দামেশ্ক : দারুল মামুন লিত্-তুরাছ, ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি., হাদীস নং-৪৩৮৬; হাদীসটির সনদ সহীহ। মুহাম্মদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ১১১৩।’
আল্লাহর খলীফা হিসেবে মানুষের দায়িত্বের কথা ভুলে না যাওয়া : ইসলামী স্থাপত্য শিল্প তৈরি কালে মানুষকে মনে রাখতে হবে যে, মানুষ এ পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা। সুতরাং স্থপতিকে তার স্থাপত্য শিল্প এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে স্থাপত্য শিল্পটি মানবকল্যাণ ও আল্লাহর দীনের দাওয়াত ও আল্লাহ ইবাদতে উৎসাহী করে।
বাথরুম (টয়লেট) কিবলামুখী না করা : স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের সময় আর যে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয় তা হচ্ছে বাড়ির অভ্যন্তরে টয়লেটগুলো যেন কিবলামুখী করে না করা হয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) পেশাব-পায়খানা করার সময় কিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তোমরা কিবলামুখী হয়ে বা কিবলাকে পিছনে রেখে পায়খানা-পেশাব করো না। ‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আবওয়াবুল কিবলাহ, পরিচ্ছেদ : কিবলাতু আহলিল মাদীনাহ্ ওয়া আহলিশ্ শাম ওয়াল মাশরিকি, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৩৮৬।’
কবরের ওপর কোন ধরনের স্থাপত্য তৈরি না করা : মুসলিমদের কবর হবে সাদাসিধে। এটি বেশি উঁচু করা যেমন হারাম, তেমন হারাম কবরের ওপর কোন স্থাপত্য নির্মাণ করা, কবর বাঁধানো, চুনকাম করা ইত্যাদি। জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরে চুনকাম করতে, কবরের ওপর বসতে এবং কবরের ওপর কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। ‘ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-জানায়িয, পরিচ্ছেদ : আন-নাহয়ু আন তাজসীসিল কবরি ওয়াল বিনা-ই আলাইহি, হাদীস নং- ২২৮৯।’
উক্ত হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, কবরের ওপর কোন কিছু নির্মাণ করা হারাম। তাই কোন ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে কোন স্থাপনা তৈরি, এমনকি কবর বাঁধানো ও চুনকাম করা, কবরের ওপর কিছু লেখা, বাতি জ্বালানো ইত্যাদি স্পষ্ট হারাম।
উপসংহার : স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার সময় তাতে উন্নত নির্মাণ শিল্প কৌশল ব্যবহার করে, মজবুতভাবে, শান্তিতে বসবাস করতে পারার মতো করে এবং ইবাদত-বন্দেগী; বিশেষত সালাত আদায়ের পরিবেশ তৈরি করে তা নির্মাণ করতে হবে। আরো খেয়াল রাখতে হবে যাতে যেখানে দীনের বিধান রক্ষা সহজতর হয়। আরো মনে রাখতে হবে যে, মানুষ এ পৃথিবীতে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসেনি, তাকে তার রবের কাছে অবশ্যই একদিন আবার ফিরে যেতে হবে। অতএব, স্থাপত্য শিল্প নির্মাণ কালে এ কথা মনে রেখেই তা তৈরি করতে হবে। তাতে বাড়াবাড়ি ও বিলাসিতা যাতে না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই স্থাপত্য শিল্প ইসলামসম্মত হবে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম দেশ। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। তাই এদেশের স্থাপত্য শিল্প অবশ্যই ইসলামী স্থাপত্য শিল্প-নীতিমালা অনুসরণ করে নির্মাণ করা বাঞ্চনীয়।
এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়- এমন স্থাপত্য কর্ম শিল্প বা সংস্কৃতির নামে তৈরি করা এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কখনই কাম্য হতে পারে না। এ প্রেক্ষিতে দেশের স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধকে ধারণ করে- এমন একটি আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। উল্লেখ্য, এ দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ হলেও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে না; বরং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে, যা বিশ্বধর্ম ইসলামের উদারতার বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামী নির্দেশনা মতো স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার তাওফীক দিন।