কানাডীয় নও-মুসলিম মিসেস ‘লারা’র মুসলমান হওয়ার কাহিনী এবং ইসলাম সম্পর্কে তাঁর কিছু বক্তব্য ও চিন্তাধারা তুলে ধরব।
ইসলাম শান্তি, মানব-প্রেম, ন্যায়বিচার, বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি, সংলাপ ও পরমত-সহিষ্ণুতার ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যে ইসলামকে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সমর্থকদের ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। পাশ্চাত্য তাদেরই মদদপুষ্ট একদল বিভ্রান্ত মুসলমানদের সহিংস আচরণকে এই বিষাক্ত প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এভাবে পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক আতঙ্ক জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে যাতে তাদের জনগণ ইসলামের সত্যিকারের রূপ ও শিক্ষা সম্পর্কে অচেতন থাকে এবং ভুলক্রমেও এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট না হয়। কিন্তু এতসব বিষাক্ত প্রচারণা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের সত্য-পিয়াসী অনেক মানুষ ইসলামের আসল রূপ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাতে গিয়ে এ ধর্মকে সত্যিকারের ঐশী ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করছেন এবং শান্তি, ন্যায়বিচার, বুদ্ধিবৃত্তিক উদারতায় পরিপূর্ণ এই ধর্মের বাস্তবতাগুলোকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কানাডীয় নও-মুসলিম মিসেস লারা হলেন এমনই এক সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেছেন:
“কয়েক বছর আগে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ পড়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলমানের কিছু ভুল পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে এইসব প্রবন্ধে ইসলামের মূলনীতিগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। আমি তখনও ছিলাম একজন অমুসলিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবমাননাকর সেইসব কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে পারিনি। বরং আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই লেখকরা ইসলাম-বিদ্বেষী ছিলেন বলেই এ ধরনের অবমাননাকর লেখা লিখেছেন। কারণ, সব সময়ই সব স্থানেই কিছু মানুষ ভুল করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে তাদের ভুল কাজের দায় গোটা জাতি, দেশ বা একটি ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। তাই এ ধরনের অন্যায় ও অবিবেচনা-সুলভ লেখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং ইসলামের মত একটি ঐশী ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের অবমাননামূলক লেখালেখির জন্য চিঠি পাঠিয়ে লিখিত প্রতিবাদ জানাই। একইসঙ্গে ইসলামের বিরুদ্ধে যে অপবাদগুলো ওইসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল সে সম্পর্কে গবেষণা ও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
মিসেস লারা ইসলাম সম্পর্কে নিজের ধারণা বা জ্ঞান বাড়ানোর জন্য মুসলমানদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন: আমি মুসলমানদের কাছে গিয়ে তাদের ধর্ম সম্পর্কে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করি। আমার কোনো এক বন্ধু যেখানে বসবাস করতেন সেখানে বহু মুসলমানও থাকতেন। আমার ওই বন্ধুর মাধ্যমে একজন মুসলিম মহিলার সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি বোরকা বা অ্যাপ্রোন জাতীয় লম্বা জামা পরতেন ও মাথা ঢেকে রাখতেন বড় রুমাল বা স্কার্ফ দিয়ে এবং খুব বিনম্র ও ভদ্রভাবে কথা বলতেন। ওই মুসলিম মহিলা আমাকে বললেন: “যেসব কথা বই-পুস্তক, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখা হয় সেসব কথা যে সত্য হবেই তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং প্রথমেই এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার ওই লেখকরা সত্যবাদী কিনা এবং ইসলাম সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা রয়েছে কিনা আগে সেটা জানাই জরুরি।”
মিসেস লারা বললেন, “মুসলিম ভদ্র মহিলার ওইসব কথার জবাবে আমি তাকে বললাম যে, আমিও ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাই যাতে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে যেসব কথা প্রচার করা হয় সেগুলো সঠিক না ভুল তা বুঝতে পারি। ওই মুসলিম ভদ্রমহিলা আমার এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন এবং তিনি আমাকে কিছু বই পড়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি পরের দিনই আমার জন্য ইসলাম সম্পর্কিত কয়েকটি বই নিয়ে আসেন। আমি বইগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলি। ওই বইগুলোর মধ্যে একটি বইয়ে হযরত মরিয়ম (সালামুল্লাহি আলাইহার) ও তাঁর পুত্র ঈসা (আ.) সম্পর্কিত কুরআনের বক্তব্য পড়ে বুঝতে পারলাম যে ইসলাম মরিয়ম (সা.)-কে পবিত্র ও আল্লাহর নির্বাচিত মহামানবী বলে মনে করে, যেমনটি সুরা আলে ইমরানের ৪২ নম্বর আয়াতে এসেছে: ‘এবং ফেরেশতারা বললেন: হে মরিয়ম, আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন, পবিত্র করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।’
এ ছাড়াও আমি বুঝতে পারি যে, ইসলাম হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর অত্যন্ত বড় নবী এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও ধর্মীয় কিতাবের অধিকারী বলে মনে করে। যেমনটি সুরা মরিয়মের ৩০ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘ঈসা বললেন, আমি আল্লাহর দাস, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও আমাকে নবী হিসেবে নিয়োগ করেছেন।’ আর এখানে আমি বুঝতে সক্ষম হই যে, কুরআন অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে ইতিহাসের বাস্তব ঘটনাগুলো তুলে ধরেছে এবং কখনও সত্যের সীমানা থেকে সরে আসেনি। “
এভাবে ঈসা (আ.) ও তাঁর মহীয়সী মা সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য মিসেস লারার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফলে তিনি ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি পড়াশোনায় আগ্রহী হন। এরপর মিসেস লারা ওই মুসলিম মহিলার দিক-নির্দেশনায় অধ্যাপক শহীদ আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারির লেখা কিছু বইয়ের অনুবাদ পড়েন। তাঁর লেখা এই বইগুলোর মধ্যে ছিল ‘ওহি ও নবুওত’, ‘পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ’ এবং ‘ ‘মানুষ ও ঈমান’। বইগুলো লারাকে ইসলামের সমৃদ্ধ জগতের প্রতি এতটাই অভিভূত ও মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে যে তিনি মনে মনে বলে ওঠেন, ” ইস্, আমি যদি একজন মুসলমান হতাম!”।
মিসেস লারা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “কিন্তু আমার মনে তখনও এই ভুল ধারণা ছিল যে, আমি মুসলমান হতে পারব না, সহজেই মুসলমানদের সমাজে ঠাঁই পাব না, কারণ, ইসলাম হল প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগুলোর ধর্ম এবং মুসলমান হতে হলে আমাকে কিছু কঠিন পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু যতই মুসলমানদের সঙ্গে মিশছিলাম ততই বুঝতে পারলাম যে আমার এইসব ধারণা খুবই ভুল। অবশেষে একদিন যখন ইসলাম সম্পর্কে আমার পড়াশোনার কথা ও এই ধর্ম গ্রহণের জন্য আমার মনের ইচ্ছার কথা নিয়ে আমার মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করলাম তারা অত্যন্ত সানন্দে আমাকে স্বাগতঃ জানালেন। আমি যখন তাদের বললাম, আমি ইসলামকে পরিপূর্ণ ধর্ম বলে মনে করি, তখন তাদের একজন মুচকি হেসে বললেন, তাহলে আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? ইসলামকে পছন্দ করলে আপনিও একজন মুসলমান হতে পারেন।”
এভাবে মিসেস লারা এই বাস্তবতাও বুঝলেন যে, ইসলাম বিশেষ কোনো জাতি, অঞ্চল বা দেশের ধর্ম নয়। এ ধর্ম কেবল প্রাচ্যের বা পূর্ব দেশীয় লোকদের কিংবা মুসলিম দেশগুলোর ধর্ম নয়। যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো দেশে ও যে কোনো পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন। আসলে পশ্চিমা শক্তিগুলোই এ প্রচারণা চালাচ্ছে যে, ইসলাম বিশেষ অঞ্চল বা জাতির ধর্ম যাতে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এ ধর্মের প্রভাব কমানো যায়। অথচ ইসলামের শিক্ষাগুলো সব যুগের সব দেশের ও সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সর্বোত্তম বিধান এবং কর্মসূচি দিয়েছে। এমনকি এই ধর্ম অন্য ধর্মগুলোর অনুসারীদেরও এই আহ্বান জানায় যে, আসুন আমরা এই চিন্তাগত মতৈক্যে পৌঁছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই।
কানাডীয় নওমুসলিম মিসেস লারা গভীর উৎসাহ নিয়ে ইসলাম সম্পর্কিত শিক্ষাগুলো জানার চেষ্টা করছেন। ইসলাম গ্রহণের পর তার অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে লারা বলেছেন:
“আমি ছিলাম এমন এক পাখির মত যে, উড়তে ভালোবাসত এবং যে নিজেকে এক পরিবর্তনের মুখোমুখি দেখতে পেল। তাই সুস্থির হতে পারছিলাম না, সব সময়ই ভাবনায় মশগুল ছিলাম। অবশেষে ইসলামকে গ্রহণ করলাম গভীর ভালোবাসা ও মন-প্রাণ দিয়ে এবং প্রবেশ করলাম এক নতুন জগতে। মনে হল আমি যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছি এবং আমার পাখাগুলো ভারমুক্ত হয়েছে। শহরের মসজিদে গেলাম এবং নিজের অজান্তেই উপস্থিতি মুসলমানদের সামনে আনন্দের অশ্রু ভরা চোখে মুসলমান হওয়ার কথা ঘোষণা করলাম। তাঁরা অবর্ণনীয় আনন্দ নিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। পুরো মসজিদেই যেন বয়ে গেল আনন্দের বন্যা।”