আমাদের জীবনে মাহে রমজান

সময়ের আবর্তে বছর ঘুরে আজ মুসলিম বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে মাহে রমজানের শুভাগমন। মাহে  রমজান আমাদের মাঝে এসেছে তাকওয়া আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম এবং মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণআত্মসম্পর্ণের পুষ্পশুভ্র ও ইস্পাতদৃঢ় চেতনা নিয়ে। নানা কারণে ও তাৎপর্যে এ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। রমজান রোজার মাস, পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস, লাইলাতুল কদরের মাস, বদর যুদ্ধের মাস, তারাবিহ, কুরআন তিলাওয়াত, ইতেকাফ, দান-খয়রাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির মাস। ত্যাগ-তিতিক্ষা সংযম, সমবেদনা ও সহমর্মিতার বার্তাবহ এ মাস রমজান। রহমত (অনুগ্রহ) মাগফিরাত (ক্ষমা) ও নাজাতের (জাহান্নাম থেকে মুক্তির) এ মাস রমজান।

রমজানের নামকরণঃ
‘রমজান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জ্বালিয়ে দেয়া, পুড়িয়ে দেয়া, বিনাশ সাধন করা, দহন করা বা পোড়ানো। যেহেতু রমজানের রোজা গুনাহসমূহ ও আত্মার সর্বপ্রকার কলুষতা ও অপবিত্রতাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তাই এ মাসের নাম রমজান।

রোজার  আভিধানিক সংজ্ঞাঃ
রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে এর  প্রতিশব্দ ‘সাওম’। যার বহুবচন হচ্ছে সিয়াম। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, কঠোর সাধনা করা, জ্বালিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া, অবিরাম চেষ্টা করা ইত্যাদি।

রোজার পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ
ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তিসহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নামই রোজা।

রোজার উদ্দেশ্যঃ
শরিয়তের প্রত্যেকটা আমলের একটা সহিহ উদ্দেশ্য থাকে। প্রত্যেক সহিহ আমলের সেই উদ্দেশ্য যদি হাসিল করা যায়, তাহলে সেই আমলের পুরোপুরি ফায়দা পাওয়া যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের উপর যে রোজার বিধান দেয়া হয়েছে। এই রোজার উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই ঘোষণা করেছেন।

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পার। (সূরা : বাকারা : ১৮৩) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র রমজান মাসে রোজা ফরজ করেছেন তাকওয়া অর্জনের জন্য। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন- রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) ইয়াহইয়াউল উলুমদ্দিন গ্রন্থে লিখেছেন, আখলাকে ইলাহি তথা ঐশ্বরিক গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে  তোলাই রোজার উদ্দেশ্য। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে।

যুগে যুগে রোজাঃ
পৃথিবীর প্রথম মানুষ থেকেই রমজানের ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। হযরত আদম (আ) চন্দ্রমাসে ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখে রোজা রাখতেন। হযরত নূহ (আ) ১লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন। এমনিভাবে হযরত ইবরাহিম (আ), হযরত মূসা (আ), দাউদ (আ), ঈসা (আ) প্রত্যেকে তাঁর নিজ নিজ সময়ে রোজা রেখেছেন। এককথায় পূর্ববর্তী বলতে হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত সকল যুগের মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। আর এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করেছেন “ইতঃপূর্বে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিল”। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এ উম্মত যেন রমজানের কষ্টের কথা শুনে ঘাবড়ে না যায়। কেননা একাকিত্বের অনুভূতি মানুষকে ঘাবড়ে দেয়। পক্ষান্তরে সে যখন জানতে পারে যে, তার উপর আরোপিত বিধান কষ্টসাধ্য হলেও সেটা অভিনব কিছুই নয় বরং পূর্বেও এ বিধান পালন করেছে। তখন স্বভাবতই সে মানসিক স্বস্তি ও শক্তি সঞ্চয় করে। তার হিম্মত মনোবল ও উদ্যম বেড়ে যায়। আসমানি যত ধর্ম ছিল যথা ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, ইবরাহিম (আ)-এর ধর্ম সব ধর্মে সিয়াম সাধনা ছিল ফরজ। কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন তথা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা জানেন, প্রাচীন সব ধর্মে রোজা পালন, পানাহার ত্যাগ ইত্যাদির প্রচলন ছিল। যথা হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, ব্যবলনীয় ধর্ম, মিশরীয় ধর্ম এবং মেক্সিকো আদিবাসীর ধর্মসহ সকল ধর্মে দেখা যায় পানাহার ত্যাগ করা ও যৌন সম্ভোগ ত্যাগ করার নির্দেশ পালন করা হতো। এক কথায় বলা যায় যে, ঐশী ধর্ম এবং অন্যান্য সকল ধর্মে রোজার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

রোজার ফজিলতঃ
রমজানের রোজার ফজিলত অনেক। ইসলামে যে সকল ইবাদতের সওয়াব ও পুরস্কার সর্বাধিক তার মধ্যে রমজানের রোজা অন্যতম। অন্য কোন ইবাদতের ফজিলত এত বেশি আলোচিত হয়নি। এখানে আমরা রমজানের রোজার ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে, আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। (বুখারি ও মুসলিম)
২. রমজান মাস এলে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। (বুখারি ও মুসলিম)
৩. রমজান মাস এলে রহমতের দুয়ার খুলে দেয়া হয়। (বুখারি ও মুসলিম)
৪. রমজান সবরের মাস, আর সবরের পুরস্কার হলো জান্নাত। (বায়হাকি)
৫. রমজানের মোমিনের জীবিকা বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। (বায়হাকি)
৬. যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো  রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ঐ রোজাদারের পুরস্কারের কমতি হবে না। (বায়হাকি)
৭. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুঘ্রাণের চেয়েও উত্তম। (বুখারি ও মুসলিম)
৮. যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবেন; আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে পান করাবেন। এরপর জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। (বায়হাকি)
৯. জান্নাতে আটটি দরজা আছে। এর মধ্যে একটির নাম রাইয়ান।  রোজাদারদের ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
১০. রোজাদারদের জন্য দু’টি আনন্দের সময় একটি হলো ইফতারের সময় আর অপরটি তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের সময়। (বুখারি ও মুসলিম)
১১. রাসূলে করিম (সা) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজ দশ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ বলেন, রোজাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ রোজা খাস করে কেবল আমারই জন্য রাখা হয় আর আমিই এর প্রতিফল দেবো। (বুখারি ও মুসলিম)

তাকওয়া সৃষ্টিতে রোজাঃ
রোজা আদায়ের মাধ্যমে মানব হৃদয়ে আল্লাহ প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় বান্দা এসব থেকে বিরত থেকে রোজা পালন করে। আল্লাহকে ভয় করার নামই তাকওয়া বা খোদাভীতি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বকে অপরাধমুক্ত করতে হলে এই তাকওয়ার কোনও বিকল্প নেই। লোক চক্ষুর অন্তরালে, পুলিশি প্রহরা যেখানে নিষ্ক্রিয়, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী যেখানে যেখানে অপারগ, স্যাটেলাইটের তী দৃষ্টি যেখানে অসহায়, সেখানেও আল্লাহর ভয় একজন ব্যক্তিকে অপরাধমুক্ত রাখতে পারে। তাকওয়া মূলত নিজের জন্য নিজেই প্রহরী। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।

রোজা ঢালস্বরূপঃ
রোজা মানুষকে ষড়রিপুর আক্রমণ থেকে ঢালস্বরূপ বাঁচিয়ে রাখে। কাম, ক্রোধ, লোভ লালসা ইত্যাদি রিপুর তাড়নায় মানুষ বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়; রোজা মানুষের এ সকল কুপ্রবৃত্তি দমন করে। এ কারণেই মহানবী (সা) বলেছেন, আস্সাওমু জুন্নাতুন অর্থাৎ রোজা ঢালস্বরূপ।

রোজা উন্নত চরিত্র গঠনের কারিগরঃ
রোজা উন্নত চরিত্রগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়। ফলে সে ভালো চরিত্রবান আলোকিত মানুষ হয়ে ওঠে।

আল্লাহ প্রেমের নিদর্শনঃ
রোজা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার প্রেম ও ভালোবাসারই নিদর্শন। এটা কোন লোক দেখানো ইবাদত নয়। র‌্যাবের ভয়ে মানুষ রোজা করে না, একমাত্র মহান রবের ভয়ে রোজা রাখে। রোজার মাসে খাওয়া ও পান করার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও মানুষ আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থাকে। তাই আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেন, রোজা আমার জন্য আর আমি এর প্রতিদান দেবো।

রোজা  ধৈর্য ও সংযমের কারিশমাঃ
বাস্তব জীবনে ধৈর্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। তাই আল্লাহ রমজানকে ধৈর্যের একটি বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মাঝে মাঝে ধৈর্য কমে যায়। তখন পানাহার ও যৌন চাহিদা থেকে দীর্ঘ এক মাস বিরত রাখার মাধ্যমে তাকে মজবুত করা হয়। দাওয়াতে দ্বীন ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কষ্ট সহ্য করার জন্য ধৈর্যের ভীষণ প্রয়োজন। শত্রুরা কিংবা অজ্ঞ লোকেরা গালিগালাজ ও হাসি ঠাট্টা করবে। ধৈর্যের সাথে এর মোকাবেলা করে হেকমতের সাথে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ধৈর্য মোমিনের সাফল্যের চাবিকাঠি। রাসূল (সা) বলেছেন, রমজান হচ্ছে ধৈর্য ও সংযমের মাস। রাসূল (সা) অন্য হাদিসে বলেছেন, রোজা ধৈর্যের অর্ধেক। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ধৈর্য ধারণকারীদের সাথে আছেন। ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবনকে সুখী ও উত্তেজনামূলক রাখার জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন। আর রমজান এ ধৈর্যের সওগাত নিয়েই বছরে একবার আমাদের দুয়ারে হাজিরা দেয়।

রোজা বিশ্ব মানবতার মুক্তির মাধ্যমঃ
কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে রোজা বান্দার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। এ মর্মে রোজাসমূহ সুপারিশ করে বলবে, হে প্রভু! আমি এ ব্যক্তিকে দিনে পানাহার ও অন্যান্য কামনা বাসনা হতে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করবেন। (বায়হাকি)

আরশের ছায়াতলে স্থান ও জান্নাত লাভঃ
কঠিন ভয়াবহ হাশরের ময়দানে যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না সেদিন সবাই স্বীয় কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ দেয়ার জন্য উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করবে- সেই বিভীষিকাময় দিনে রোজাদারগণ আল্লাহর আরশের ছায়াতলে স্থান লাভ করবে এবং পরিশেষে জান্নাত লাভ করবে।

রোজা আদর্শ সমাজ গঠনের মাইলফলকঃ
রোজা এমন এক ইবাদত, যা পালন করার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ গঠন করা যায়। মানুষ যখন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, বিদ্বেষ, মিথ্যা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, গিবত, ঝগড়া-ফাসাদ, পরচর্চা, চোগলখুরি, অশ্লীলতার চর্চা, ব্যভিচার ইত্যাদি অসৎ স্বভাব থেকে মুক্ত থাকে তখন সমাজে সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধি বিরাজমান থাকে। গঠিত হয় আদর্শ সমাজ।

রোজা বিনোদনের এক অন্যতম মাধ্যমঃ
সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যার সময় ইফতার করার পর রোজাদার যে মানসিক ও প্রশান্তি ও স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করে তা সত্যিকার অর্থে অতুলনীয়। আসলেই রোজা দেহ ও মনের এক আশ্চর্যজনক পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা।

আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব দৃঢ়করণঃ
পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানগণ রমজান মাসে সাওম পালন করে। এ সময় মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণ পরস্পরের নিকট শুভেচ্ছাবাণী প্রেরণ করেন। প্রখ্যাত আলিমগণ সফর বিনিময় করেন। এতে মুসলমানদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ভাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায় ও দৃঢ় হয়।

প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা: জিসি গুপ্ত বলেছেন, পবিত্র ইসলামে রোজা পালনের যে আদেশ করেছেন তা মানবের আত্মিক দৈহিক মঙ্গলের জন্য সত্যিই আকর। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
ডা: আর ক্যাসফোর্ডের মতে, রোজা হলো পরিপাকশক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।
অধ্যক্ষ ডা: ডি. এফ ফোর্ট বলেছেন, রোজা পালন আত্মশুদ্ধি ও সংযমের অন্যতম উপায়। যার মাধ্যমে ¯্রষ্টার পরিচয় ও অনুগ্রহ লাভ করা যায়। স্বাস্থ্য রক্ষা করা সহজ হয়। হিংসা-বিদ্বেষ ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বাঁচা যায়।
ডা: এ্যালেক্স বলেন, রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এক বিশেষ বিশেষ অনুভূতি ও উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়।
মনস্তত্ত্ববিশারদ সিগমন্ড নারায়েড বলেন, রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কে এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়ে যায়। মানসিক অবসাদ হতেও মুক্তি লাভ করে। রোগ জন্ম দেয়। সিয়াম অতিভোজন থেকে মানুষকে বিরত রাখে এবং শরীরে বিষাক্ত উপাদান পঞ্জীভূত হতে দেয় না।

রাসূল (সা) এর রমজানঃ
রামজান মাসের পূর্ব থেকেই রাসূল (সা) এই মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিতেন। রমজানের পূর্বে শাবান মাসেই রাসূল (সা) এর ইবাদত বেড়ে যেত। শাবান মাসের প্রায় পুরোটাই তিনি রোজা রাখতেন। তবে রমজানের এক বা দু’দিন আগে রোজা রাখতেন না।

এ মাসে রাসূল (সা) এর দানশীলতা বাতাসের গতির চেয়েও বেড়ে যেত। এ মাসে হযরত জিবরাইল (আ) এর কাছে তিনি কোরআন শিখতেন। রাসূল (সা) শেষ দশ রাতে বেশি বেশি জাগতেন। পরিবার পরিজনকে জাগাতেন এবং ইবাদতের জন্য পরিধেয় বস্ত্রকে শক্তভাবে বেঁধে নিতেন।

রাসূল (সা) ইফতারও তাড়াতাড়ি করতেন এবং মাগরিবের নামাজও তাড়াতাড়ি পড়তেন।
লাইলাতুল ক্বদর এলে তিনি বেশি বেশি পড়তেন এই দোয়াটি-
“আল্লাহুমা ইন্নাকা তুহিববুল আফওয়া ফা ফু আন্নি” অর্থ হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পছন্দ কর। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

নবী করিম (সা) রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফে বসতেন। এ মাসে তিনি রমজানের রোজার সাথে সাথে প্রতি রাতে তারাবির নামাজ আদায় করতেন। রাসূল (সা) বলেন- সে ব্যক্তির উপর লা’নত যে রমজানের রোজা পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারল না।

উপসংহারঃ
রমজানের রোজা মূলত একটি প্রশিক্ষণ কোর্স। এ কোর্সের প্রশিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সেই প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী। প্রশিক্ষণ কোর্সের সিলেবাস হলো রোজার নিয়ম-কানুন, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফলসমূহ। আর তার ফলাফল তথা নম্বরপত্র হিসেবে বলা যায় তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন। তাকওয়া অর্জনই মূলত সিয়ামের মূল টার্গেট। সিয়াম পালন করে যে ব্যক্তি তাকওয়া অর্জন করতে পারেনি সে ব্যক্তি হলো ঐ কৃষকের ন্যায়, যে চাষাবাদ করলো পুরো মৌসুম ধরে কিন্তু ফসল ঘরে উঠাতে পারল না। তার পরিশ্রম-ঘাম সবই বৃথা গেল। এবার সে না খেয়ে অনাহারে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সিয়াম নামক এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে পারবে না- সে হাশরের ময়দানে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ও অপমানিত হয়ে জাহান্নামের নিক্ষিপ্ত হবে। আমরা হাদিস শরিফ থেকেই জানতে পারি “যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল কিন্তু গুনাহ মাফ চেয়ে নিতে পারল না; সে অবশ্যই ধ্বংসে নিপতিত হবে।” আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সেই সব প্রশিক্ষণার্থীদের সারিতে শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন, যারা সিয়ামের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মিক ও সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে তাকওয়া অর্জনের ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জান্নাত লাভে ধন্য হবে। আমিন।

লেখক: সাকী মাহবুব, প্রাবন্ধিক, গবেষক