আল্লাহ মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক, প্রতিবেশীর সাথে আচরণ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন, সমরনীতিসহ অর্থনৈতিক জীবনধারা ও মাপকাঠী কী হবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দিয়েছেন। অর্থনীতির সাথে ব্যবসায় বাণিজ্য, লেনদেন ও ব্যাংকিং-কার্যক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পবিত্র কুরআনের চারটি সূরায় ১২টি আয়াতের মাধ্যমে সুদকে বা রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের যুগের লোকেরা মানুষের কাছ থেকে যে সুদ নিত, আর বর্তমানে ব্যাংক ব্যবসায় যে সুদ আদায় করা হয়, তা একই। এটি একটি জুলুম বিধায় আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। সুদের ৭০ রকমের গুনাহ রয়েছে। তার মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হলো- আপন মায়ের সাথে ব্যবিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান গুনাহ। হাদিসে বলা হয়েছে, সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের লেখক ও সাক্ষী এই চারজনের ওপর লানত বা অভিশাপ, যা বর্তমান সুদি ব্যাংকিংয়ের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। সুদকে প্রতিটি ধর্মেই ঘৃণার চোখে দেখে। সুদ মানবিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কারণ এটি শোষণ ও শাসনের হাতিয়ার।
ইসলামি অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মুসলিম মনীষী ও দার্শনিকদের মাঝে আগ্রহ ছিল ব্যাপক এবং অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আবু ইউসুফ (৭৩১-৭৯৮), মুহাম্মদ বিন আল হাসান ও আল সাইবানি (৭৫০-৮০৪), আবু উবাই (৭৬৬-৮৩৮), ইয়াহিয়া ইবনে আদম (৭৫২-৮১৬), হারিস বিন আসাদ আল মুহাসিবা (৭৮১-৮৫৭), জুনাইদ বাগদাদি (৮৪০-৯১০), ইবনে মিসকাওয়াইহ (৯৬০-১০৩০), মাওয়ারর্দী (৯৭৪-১০৫৮), ইবনে হাজম আল কুরতুবি আল আন্দালুসি (৯৯৪-১০৬৪), আল গাজ্জালি (১০৫৫-১১১১), নাসির উদ্দিন তুসি (১২০১-১২৭৪), ইবনে তাইময়া (১২৬৩-১৩২৮), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬), মাওয়ারদি (৯৪৭-১০৫৮), শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-১৭৬১), আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৬০-১৯৩৮) উল্লিখিত মনীষীরা বিভিন্নভাবে খাজনা, কর, ওশর, জাকাত, বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রকে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত করা ও সুদের, ফটকা কারবারি, মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা, সুশাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতেন। গবেষণা করতেন শরিয়তের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও। এসব মুসলিম দার্শনিকদের চিন্তাধারায় ব্যাস্টিক ও সামস্টিক অর্থনীতির তত্ত্ব বিনির্মাণে প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর গোড়ার দিকে একাধিক মুসলিম অর্থনীতিবিদের কয়েকটি বিশ্লেষণ ও গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়, যাতে মুনাফা বণ্টন, উৎপাদন, ভোগ, জাকাত ও সুদ বিলোপসাধনে অর্থনৈতিক ফলাফল ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবের মক্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামি অর্থনীতির ওপর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুসলিম ইকোনমিক থিংকিং নামে একটি প্রবন্ধে উপযুক্ত বিষয়াদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর ৫০টির অধিক দেশে ইসলামি ব্যাংকিং-ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং-ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলে। ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে আইডিবির চার্টারে স্বাক্ষর করে ও শরিয়ার ভিত্তিতে ব্যাংকিং ও অর্থনীতি চালুর প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে ইসলামি ব্যাংকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে বাংলাদেশ সরকার চার্টারে স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
১৯৭৯ সালের নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দুবাই ইসলামি ব্যাংকের অনুরূপ একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পররাষ্ট্র সচিবকে সুপারিশ করেন।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক ইসলামি ব্যাংকিং-কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য দুবাই, মিসর পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৮১ সালে সুপারিশ তুলে ধরেন। ১৯৮০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ও আইসিভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক সদস্য দেশগুলোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। ১৯৮১ সালে সুদানে ও আইসিভুক্ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের গভর্নরও ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লেখা পত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাখাগুলোতেও পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং কাউন্টার করে এ জন্য পৃথক লেজার রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
ইসলামি ব্যাংকগুলো মানুষের সাথে প্রতারণা করতে পারে না। তাদের ধর্মের প্রতি, সমাজের প্রতি, জনগণের প্রতি, সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রতি কমিটমেন্ট আছে। বিগত বছরগুলোতে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো যত মুনাফা করেছে, অন্যান্য সুদি ব্যাংক তার তুলনায় কম মুনাফা অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামি ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় ফিন্যান্সিয়াল ইনকুশন ঘটেছে ব্যাপক হারে। সব ইসলামি ব্যাংকে গ্রাহকসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ইসলামি ব্যাংকিং-ব্যবস্থা যদি ফ্রড হতো তাহলে গ্রাহক এর সাথে থাকত না। ইসলামি ব্যাংকিংয়ে লোন দেয়া হয় না, বিনিয়োগ করা হয়। বেচাকেনা পদ্ধতি, অংশীদারি পদ্ধতি, ইজারা ভাড়া পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসায় করে থাকে, যা পুরোপুরি শরিয়াহসম্মত। আল কুরআনে ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করা হয়েছে, আর সুদকে হারাম করা হয়েছে। ইসলামি ব্যাংকগুলো যদি আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেয় তাহলে দেশের শিল্প কলকারখানা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আসীন।
ইসলামি ব্যাংক গ্রিড ব্যাংকিং করে না বরং নিড ব্যাংকিং করে। দাতাগ্রহীতার ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে কাজ করে। শুধু মুনাফাই দেখে না, মানুষের কল্যাণ, পরিবেশের ভারসাম্য বিবেচনা করে। ধনীকেই ধনী বানানোর পরিবর্তে সমাজের অভাবী, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইসলামি ব্যাংক। সুদ শোষণের হাতিয়ার, পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, ধনী-গরিবের দূরত্ব সৃষ্টি করে, পুঁজিকে অলস রাখে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। সুদি ব্যাংক টাকার কেনাবেচা করে। নৈতিকতার অধপতন ঘটায়, একে অপরের দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। পরস্পর অনাস্থা ও বিশ্বাসহীনতার জন্ম দেয়। ইসলামি ব্যাংকিং উৎপাদন ও সুষম বণ্টন, সামগ্রিক উন্নয়ন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নৈতিকতা নিশ্চিত ও উন্নত করে। সুদি ব্যাংক-ব্যবস্থায় পরকালীন জীবনে জবাবদিহিতার অনুভূতি না থাকায় হতাশা, ঘুষ, দুর্নীতি, শোষণ, অন্যায় চেপে বসার সুযোগ আছে; কিন্তু ইসলামি ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় পরকালীন জীবনে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকায় এগুলোর সুযোগ নেই।
ইসলামি ব্যাংকিং মানবিকতার দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। ইসলামি ব্যাংকিং গতানুগতিক ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি মানবিক ব্যাংকিংও করে থাকে। তাই এ ব্যাংককে মানবতার ব্যাংকও বলা যায়। দেশের ৫৬টি ব্যাংক যদি এ মানবিক ব্যাংকিং ধারা চালু করে, তবে দেশের আর্থিক খাতে ফিন্যান্সিয়াল ইনকুশন ঘটবে ব্যাপকভাবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। ব্যাংকিংয়ের এ ধারা একটি সর্বজনীন আর্থিকব্যবস্থা, যা ইতোমধ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারের এমডিজি লক্ষ্য পূরণে ইসলামি ব্যাংক ভূমিকা রেখেছে। দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পেছনেও এর অবদান রয়েছে। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। ভবিষ্যতে হয়তো কোনো একদিন এ ব্যাংকিং ধারা মানবিক ব্যাংকিং ও দারিদ্র্যবিমোচন করার কারণেই দেশকে স্বয়ম্বর করে দেবে।
লেখক: ব্যাংকার