কেবল বস্তুগত সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে দেয় না কাঙ্ক্ষিত সুখ ও প্রশান্তি। আধ্যাত্মিকতামুক্ত ও ধর্মহীন পরিবেশে ব্যাপক সম্পদ ভোগ করেও মানুষ যে সুখী হয় না তার প্রমাণ হল পাশ্চাত্যের জনগণের প্রশান্তিহীনতা। পশ্চিমা মতাদর্শের মূল কথাই হল,পার্থিব জীবন ভোগের জীবন। কিন্তু মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই। এ বিষয়টি পশ্চিমাদেরকে উদ্দেশ্যহীনতার যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলাম বলে, মৃত্যুই মানুষের জীবনের শেষ কথা নয়। পরকালে থাকবে সত কাজগুলোর জন্য পুরস্কার। আর এই চিন্তা নিয়ে ধার্মিক মানুষেরা বেশি বেশি সত কাজ করেন বলে মৃত্যু নিয়ে তারা শঙ্কিত থাকেন না।
একজন মুমিন বা বিশ্বাসী ব্যক্তি অস্তিত্ব জগত সম্পর্কে সুধারণা রাখেন। তার দৃষ্টিতে খোদায়ী বিধান সঠিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ। তার মতে খোদা দয়ালু ও করুণাময়। তাই বিশ্বাসীরা জীবনকে নিয়ে সন্তুষ্ট ও সুখী। কঠিন সংকট আর বিপদের চড়াই-উতরাই তাদের বিচলিত বা হতাশ করে না। কারণ, তারা জানেন জীবনে সমস্যা এবং বিপদ ও কষ্টও উদ্দেশ্য বা তাতপর্যহীন নয়। বিশ্বাসীরা সুখের সময়ও ভারসাম্যপূর্ণ কথাই বলেন এবং সব সময় আল্লাহকে হাজির-নাজির বলে জানেন। সুখে ও দুঃখে সব অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই তাদের লক্ষ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মুমিন বা বিশ্বাসীরা কেবল নিজের কল্যাণ নিয়ে ভাবেন না, তারা অন্যদের কল্যাণের জন্যও সচেষ্ট থাকেন। সব সময় আশাবাদী থাকেন বলে তারা গভীর মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করেন।
অন্যদিকে যারা ধর্মে বিশ্বাসী নন তারা নানা উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা এবং মানসিক রোগে ভোগেন। অন্যদিকে যাদের ঈমান যত দৃঢ় তাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা ততই কম। আর এ কারণেই আর্নেস্ট রেননের মত পশ্চিমা চিন্তাবিদরা মনে করেন, ধর্ম ও ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ কখনও বিলুপ্ত হবে না। বরং বস্তুবাদীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্ম চিরকাল টিকে থাকবে। সত্য ধর্মের এই প্রবল আকর্ষণের কারণেই বস্তুবাদীতা আর লাগামহীন স্বাধীনতার প্রতি বিতৃষ্ণ পাশ্চাত্যের অনেকেই ইসলামের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন লক্ষ্যহীনতা ও আত্মপরিচিতিহীনতা থেকে মুক্তি এবং ধ্বংসাত্মক স্বাধীনতার অন্ধকার থেকে আধ্যাত্মিক জ্যোতির্ময়তার আলোকবর্তিকা। জার্মান যুবতি তানিয়া পোলিং হচ্ছেন এমনই সৌভাগ্যবানদের একজন। হামবুর্গের এই যুবতী মুসলমান হওয়ার ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন:
“হামবুর্গের একটি বিপণী কেন্দ্রে হিজাব পরিহিতা একজন মুসলিম নারী ঘুরিয়ে দিয়েছেন আমার জীবনের মোড়। কয়েকজন বান্ধবী আমার সঙ্গে ছিল। আমরা সবাই মিলে ওই মুসলিম নারীকে উপহাস করছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম: ‘অসুখ বা রোগের মত এই কী পোশাক তুমি পরেছ?’ওই মহিলা এর উত্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন,’তুমি কেন নিজেকে এভাবে প্রদর্শন করছে?’এভাবে এক অভাবিত সংলাপের মাধ্যমে তিনি আমাকে এটা বুঝিয়ে দিলেন যে,পোশাক-পরিচ্ছদ,লজ্জা নিবারণ ও পবিত্রতা-এসবই হচ্ছে মানসিক সুস্থতা ও ভারসাম্যের নিদর্শন এবং হিজাবই নারীকে দেয় স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তা। এরপর আমরা নিজ নিজ পথে ফিরে গেলাম। কিন্তু ওই মহিলার জোরালো যুক্তি ও আত্মবিশ্বাস এবং ধর্ম সম্পর্কে সচেতনতা দীর্ঘকাল আমার মনকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। হিজাবের প্রসঙ্গ ও সেই মুসলিম মহিলার বক্তব্য নিয়ে বহুকাল ধরে ভাবনায় মগ্ন থাকতাম। একদিন কৌতূহলী মন নিয়ে হামবুর্গের মসজিদে প্রবেশ করলাম। সেখানে বিভিন্ন দেশের মুসলিম ভাইবোনদের সঙ্গে কথা বললাম। সেখানে আমি এটা উপলব্ধি করলাম যে,হিজাব নারীর জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা তো তৈরিই করে না, বরং তাদেরকে সমাজে বেশি কাজ করার সুযোগ ও সুস্থ উপস্থিতির নিরাপত্তা দেয়।”
জার্মান নও-মুসলিম তানিয়া পোলিং মনে করেন,মুসলিম নারীর হিজাব যেন অন্যদের এটা বলছে যে,”আমি নিজেকে অন্যদের কাছে প্রদর্শন করতে চাই না।”
এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন: “আমি এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেছি যে, ইসলাম নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে তাদের মহত প্রকৃতি ও আত্মার কারণে, শরীরের কারণে নয়। হিজাব নারীর জন্য আত্মিক ও মানসিক অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। এ ছাড়াও সামাজিক পরিবেশকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব রাখছে হিজাব। এভাবে হিজাব পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের ভিত্তিগুলোকেও মজবুত করে। মুসলমানদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়তে থাকায় ইসলামের অন্য অনেক দিকও আমাকে আকৃষ্ট করতে থাকে। আল্লাহর সঙ্গে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্ক –এইসবও আমার কাছে বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির কোনো ভৌগলিক সীমারেখা বা জাতিগত সীমানাও দেখলাম না। মুসলমানরা সবাই একই লক্ষ্যে কাজ করছে। এভাবে যতই মুসলমানদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়ছিল ততই তাদের প্রতি আমার সম্মান ও ভালবাসা বাড়তে থাকে। অবশেষে আমি এটা অনুভব করলাম যে আমি নিজেও মুসলমান হয়ে গেছি।”
জার্মান নও-মুসলিম তানিয়া পোলিং পশ্চিমা সমাজ সম্পর্কে বলেছেন: “পশ্চিমাদের মধ্যে মানবীয় ও স্নেহময় সম্পর্ক খুবই দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে বাহ্যিকভাবে পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সবাই যেন একাকীত্ব অনুভব করছে ও একাকী জীবন যাপন করছে। মুসলমান হওয়ার পর আমি নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন যাপন করাকেই এখনও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমি মুসলমান থাকার ব্যাপারে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ এবং আমার বাবা-মাও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে তেমন কোনো মনোমালিন্য নেই। এমনকি তারা আমার ইসলামী আচার-আচরণকে আমার অতীতের আচরণের চেয়ে বেশি পছন্দনীয় বলে মনে করেন। আমি অবসর সময়ে অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে পবিত্র কুরআন এবং জার্মান ভাষায় অনূদিত ধর্মীয় বই-পুস্তক বেশি অধ্যয়ন করি।”
জার্মান নও-মুসলিম তানিয়া পোলিং মনে করেন তিনি যা যা হারিয়েছেন তার বিনিময়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। সব কিছু থাকলেও খোদার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারণে বাস্তবে কোনো কিছুই না থাকার বেদনা বা অস্তিত্বহীনতার বেদনা অনুভব করতেন এই জার্মান যুবতী। কিন্তু এখন খোদাকে পেয়ে ইসলামের মধ্যে সব কিছু পেয়েছেন বলে মনে করছেন। তানিয়া পোলিং বলেছেন,তিনি এখন পেয়েছেন আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা বা আত্মার মুক্তি, আত্মিক প্রশান্তি এবং একজন মহত ও পছন্দনীয় নেতা। ইসলাম গ্রহণের ফলে পেয়েছেন পবিত্র কুরআন যা হচ্ছে আল্লাহর দেয়া বিধান এবং এটা তার জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি। তানিয়া পোলিং বলেছেন:
“আমি যেন বিশ বছরের এক সুদীর্ঘ অন্ধকার রাত কাটিয়েছি এবং এরপর আমার জীবনে এসেছে সূর্যোদয় । ইসলামের সূর্য আমাকে পরিণত করেছে বসন্তের এক প্রাণোচ্ছল নব কিশলয়ে যে কিশলয় জেগে উঠেছে বিশ বছরের দীর্ঘ শীত-নিদ্রার পর।”