‘আমিনা এসলিমি’ নামের একজন মার্কিন নও-মুসলিম মহিলার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা অনেকেরই জানা। তবে তার আত্মকথা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। এখানে সেই কাহিনী তুলে ধরা হল। পবিত্রতা ও শান্তিপিয়াসী মানুষ ধর্মমুখী হচ্ছেন। ধর্ম মানুষের প্রকৃতিগত বিষয়। তাই তা ইতিহাস ও ভৌগলিক সীমারেখার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ধর্ম নানা জাতি, গোত্র ও শ্রেণীর মধ্যে গড়ে তুলে ঐক্য ও সম্পর্ক। তাই যারা নিজের সত্যপিয়াসী প্রকৃতির দিকে ফিরে যেতে চান, ধর্ম তাদেরকে ফিরিয়ে দেয় পবিত্রতা ও শান্তি আর এমনই পবিত্রতা ও শান্তি পাচ্ছেন সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ ঐশী ধর্ম ইসলামের মধ্যে আমিনা এসলিমির মত সত্যপ্রিয় পশ্চিমা নাগরিকরা। পেশায় সাংবাদিক মিসেস আমিনা এসলিম ছিলেন একজন গোঁড়া খৃস্টান ও খৃস্ট ধর্মের প্রচারক। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি প্রচার করতেন খৃস্ট ধর্ম। তিনি মনে করতেন, ইসলাম একটি কৃত্রিম ধর্ম এবং মুসলমানেরা হল অনুন্নত ও পশ্চাদপদ একটি জাতি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটারের একটি ভুল তার জীবনের মোড় পুরোপুরি বদলে দেয়। বর্তমানে তিনি বিশ্ব মুসলিম নারী রক্ষার কাজে মশগুল ।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মার্কিন নওমুসলিম আমিনা এসলিমি এখন সম্পূর্ন ভিন্ন ধরণের মানুষ। এক সময়ের খৃস্ট ধর্ম প্রচারক এই নারী আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মানুষের মনে জ্বালাতে পেরেছেন ইসলামের প্রোজ্জ্বল ও প্রদীপ্ত আলোর শিখা। তিনি বলেছেন ইসলাম আমার হৃদয়ের স্বপন্দন ও আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত রক্তধারা এবং আমার সমস্ত প্রেরণার উৎস হ’ল এই ইসলাম। এ ধর্মের সুবাদে আমার জীবন হয়েছে অপরূপ সুন্দর ও অর্থপূর্ণ। ইসলাম ছাড়া আমি কিছুই নই। মার্কিন নও-মুসলিম আমিনা এসলিমি কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন টার্মের ক্লাশে ভর্তি হওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে একটি ভুল বিষয়ের ক্লাশে ভর্তি হন। কিন্তু এই সময় সফরে থাকায় তিনি তার এই ভুল বুঝতে পারেননি। পরে যখন এই বিষয় সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন জানতে পারেন যে, এই বিষয়ের ক্লাশে যোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আর ওই ক্লাশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই আরব মুসলমান। যদিও মিসেস এসলিমি আরব মুসলমানদের ঘৃণা করতেন, কিন্তু বৃত্তির অর্থ বাঁচানোর জন্য তাদের সহপাঠী হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না তার। এ অবস্থায় তার মন খুব বিষন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু তার স্বামী যখন বললেন, হয়তো স্রষ্টা এটাই চেয়েছিলেন এবং তিনি হয়তো তোমাকে আরব মুসলমানদের মধ্যে খৃস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন; তখন খৃস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই মিসেস এসলিমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই ক্লাশে গেলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগ হলেই নানা অজুহাতে তাদের কাছে খৃস্ট ধর্মের দাওয়াত দিতেন মিসেস এসলিমি। তারা যেন নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করেন। কারণ, ঈসা মাসীহ মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অবশ্য তারাও অর্থাৎ আরব মুসলিম শিক্ষার্থীরাও বেশ ভদ্রতা ও সম্মান দেখিয়ে মিসেস এসলিমির কথা শুনতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে এইসব কথার কোন প্রভাব পড়ত না। এ অবস্থায় মিসেস এসলিমি ভিন্ন পথ ধরতে বাধ্য হন। তিনি এ পুস্তক দিয়েই তাদের কাছে এ ধর্মের ভুল চিন্তা-বিশ্বাস প্রমাণ করব। এই উদ্দেশ্যে আমার বন্ধুদের বললাম, তারা যেন আমার জন্য পবিত্র কুরআনের একটি কপিসহ কিছু ইসলামী বই-পুস্তক নিয়ে আসেন, যাতে এটা দেখানো যায় যে, ইসলাম ধর্ম একটি মিথ্যা ধর্ম এবং তাদের নবীও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নয়। এভাবে মার্কিন সাংবাদিক মিসেস এসলিমি বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া পবিত্র কুরআন পড়া শুরু করেন। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে পাওয়া দুটি ইসলামী বইও পড়েন তিনি। এ সময় তিনি ইসলামী বই-পুস্তক পড়ায় এত গভীরভাবে নিমজ্জিত হন যে, দেড় বছরের মধ্যে তিনি পনেরটি ইসলামী বই পড়েন এবং পবিত্র কুরআন দুইবার পড়া শেষ করেন। চিন্তাশীল হয়ে উঠা মিসেস এসলিমি বদলে যেতে থাকেন। মদ্যপান ও শূকরের মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন তিনি। সব-সময়ই পড়াশুনায় মশগুল থাকতেন এবং নারীপুরুষের অবাধ-মেলামেশার সুযোগ থাকত এমন সব পার্টি বা উৎসব অনুষ্ঠান বর্জনের চেষ্টা করতেন। সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে মিসেস এসলিমি বলেছেন- কখনও ভাবিনি যে, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে গেলে বিশেষ ঘটনা ঘটবে এমনকি আমার প্রাত্যহিক জীবন-ধারাও বদলে যাবে। সে সময়ও এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, খুব শিগগিরই আমি আমার হৃদয়ের প্রশান্তির পাখাগুলো ও ঘুমিয়ে থাকা ঈমান নিয়ে ইসলামী বিশ্বের সৌভাগ্যের আকাশে উডডয়ন করব ।
এর পরের ঘটনা বলতে গিয়ে মিসেস এসলিমি বলেছেন, আমার আচরণে কিছু পরিবর্তন আসা সত্ত্বেও নিজেকে তখনও মনে করতাম। একদিন একদল মুসলমানের সঙ্গে সংলাপের সময় আমি যতই তাদের প্রশ্ন করছিলাম, তারা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে সে সবের জবাব দিচ্ছিলেন। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আমার অদ্ভুত সব মন্তব্য ও বক্তব্যের জন্য তারা আমাকে একটুও পরিহাস করেন নি। এমনকি ইসলাম সম্পর্কে আমার তীব্র আক্রমনাত্মক বক্তব্য শুনেও তারা মোটেও দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হননি। তারা বলতেন, জ্ঞান মুসলমানের হারানো সম্পদ। আর প্রশ্ন হ’ল জ্ঞান অর্জনের একটি পথ। তারা যখন চলে গেলেন মনে হ’ল আমার ভিতরে যেন কিছু একটা ঘটে গেছে। এরপর থেকে মুসলমানদের সঙ্গে মিসেস এসলিমির যোগাযোগ বাড়তে থাকে। আমি যখনই নতুন কিছু প্রশ্ন করতাম তখনই তারা আমার কাছে আরও কিছু নতুন প্রসঙ্গ তুলে ধরতেন। এ অবস্থায় একদিন একজন মুসলিম আলেমের সামনে সাক্ষ্য দিলাম- আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল।
মুসলমান হওয়ার পর হিজাব বা পর্দা বেছে নেন মিসেস এসলিমি। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের ও সন্তানের মালিকানারাও প্রশ্ন চলে আসে। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিচারক তাকে তার দুই সন্তান ও ইসলামের মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে মহাদ্বিধা-দ্বন্দের পড়েন মিসেস এসলিমি। একজন মমতাময়ী মায়ের জন্য সন্তানের দাবী ত্যাগ করা তো দূরের কথা, তাদের কাছ থেকে একদিনের জন্যও দূরে থাকাও বিশেষ কঠিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি ও মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মার্কিন নও-মুসলিম মিসেস এসলিমি। দুই বছর ধরে ইসলাম সম্পর্কে তার গবেষণা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতাই তাকে শক্তি যুগিয়েছে। তার মনে পড়ে কুরআনে উল্লিখিত হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম ) এর সন্তান কুরবানী দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনের ঘটনা। মনে পড়ে কুরআনের এই আয়াত- যে ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান হতে পারে, যে । আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করেছে? বস্তুতঃ তার ঠিকানা হল দোযখ আর তা কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল। মার্কিন নওমুসলিম মিসেস এসলিমি মুসলমান হওয়ার পর আমেরিকায় ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। কয়েক বছরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের জন্য আরবী ভাষায় ঈদের শুভেচ্ছার সরকারী স্ট্যাম্প প্রকাশ করতে মার্কিন সরকারকে সম্মত করেন।
মিসেস আমিনা এসলিমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ও শহরে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার অনুভূতি তুলে ধরে বক্তব্য বা ভাষণ দিয়েছেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এইসব ভাষণ শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এইসব প্রচেষ্টার অন্যতম সুফল হিসেবে একদিন তার দাদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তার বাবা, মা, বোনও মুসলমান হন। এর কিছুকাল পর তার সাবেক স্বামীও জানান যে, তিনি তার তাদের মেয়েরা মায়ের ধর্মই অনুসরণ করুক। তিনি মেয়েদেরকে কেড়ে নেয়ার জন্য তার কাছে ক্ষমাও চান। আর এসলিমিও তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অপরাধে একদিন যারা তাকে ত্যাগ করেছিল, তারা সবাই তাদের ভুল বুঝতে সক্ষম হয় এবং সত্যকে স্বীকার করে নেয়। প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ফিরে পাওয়াকে এসলিমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য আরও একটি বড় বিজয় বলে মনে করেন। এভাবে আল্লাহ যাকে চান তাকে ঈমানের মহা সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। তিনি জানেন কারা সত্যের ও আল্লাহর প্রেমিক।