ঈমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণের উপায়

এইচ এম মুশফিকুর রহমান |

অনুবাদ
“হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিব (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালাকে রব, ইসলামকে জীবনবিধান ও মুহাম্মদ (সা)-কে রাসূল হিসেবে শুধু ঈমান আনেনি বরং মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন ও সন্তুষ্ট হয়েছেন, তিনি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পেয়েছেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

পটভূমি
বিদায় হজে আরাফাতের মাঠে নবীজি (সা) যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন তার প্রতিটি শব্দ মানবতার জন্য একটি সোনালি দলিল। তাতে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি দু’টি অমূল্য বস্তু। যতদিন তোমরা তা শক্ত করে ধারণ করবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, গোমরাহিতে হারিয়ে যাবে না। একটি আল্লাহর কিতাব অপরটি সুন্নাতে রাসূল (সা)।” এ সুন্নাতে রাসূলের (সা) উৎস হচ্ছে হাদিসে নববীর মহা সরোবর। এ হাদিসের আলো ব্যতিরেকে কুরআনের হিদায়াত গ্রহণ সম্ভব নয়। উম্মাহর রাহবার যাঁরা তাদেরকে কুরআনুল কারিম ও হাদিসে রাসূল (সা)-কে সমান গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে।

আলোচিত হাদিসের উৎস
সনদের বিবেচনায় ইমাম বুখারী তাকে ‘মরফু হাদিস’ বলে গ্রহণ করেছেন। যেহেতু রাবী হাদিসটি মুহাম্মদ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, আর হাদিসের সনদ মুত্তাসীল সেহেতু নবীয়ে কারিম (সা) থেকে গ্রন্থাবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত কোনো রাবী ধারাবাহিকতা থেকে বাদ যায়নি। বিশুদ্ধতার বিচারে বর্ণিত হাদিসটিকে প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে গ্রহণ করা যায়। ইমাম বুখারী (রহ) ও ইমাম মুসলিম (রহ) উভয়ে তাদের সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে হাদিসটি বিশুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

হাদিসের প্রথম রাবী
হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রা)। তিনি রাসূলে কারিমের প্রিয় চাচা। বয়সে নবীয়ে কারিম (সা) থেকে ২-৩ বছরের বড়। তিনি কুরাইশদের প্রতাপশালী ব্যক্তিদের একজন। তিনি আবদুল মোত্তালিবের পর কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্ব হতে তিনি মুহাম্মদের (সা) অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী ছিলেন।

আকাবার বায়াতের অনুষ্ঠানে ছিলেন ৭২ জন মদীনাবাসী আনসার। অনুষ্ঠান চলছিল নিশীথ রাতে, হজের মৌসুমে ও মুজদালিফার পাহাড়ে। সে সময় খঞ্জর হাতে এক জন সাহসী ব্যক্তি নবীয়ে করিমের (সা) এর পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন। ঈমান না এনেও ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিটি আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিব।

মক্কার কুরাইশদের চাপে তিনি বাধ্য হয়ে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন ও মুশরিকদের সাথে বন্দী হয়ে মদীনায় আসেন। শক্তভাবে বাঁধনের কারণে তিনি রাতে কাঁতরাতে থাকেন। তাঁর কষ্টে রাসূলুল্লাহ (সা) ঘুমাতে পারছিলেন না, তিনি নির্দেশ দেন, “আমার চাচা আব্বাসসহ সকল বন্দীর বাঁধন হালকা করে দাও ও তাদেরকে বস্ত্র দাও।” ঘটনাচক্রে দীর্ঘদেহী আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে যিনি গায়ের জামা দিয়েছিলেন তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই।

যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। হযরতের চাচা এত বেশি অর্থ প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলে নবীজি (সা) বলেন, “আপনি উম্মুল ফজলের নিকট যে অর্থ ও স্বর্ণ রেখে এসেছেন তা থেকে দিন।”

বিম্ময়ের সাথে হযরত আব্বাস বলে উঠলেন, আল্লাহর শপথ, উম্মুল ফজলের নিকট গচ্ছিত অর্থের বিষয় আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি ঘোষণা দিচ্ছি, “নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল।”

তিনি মক্কায় থাকা অবস্থায় কাফেরদের গতিবিধি রাসূল (সা)-কে অবহিত করতেন ও নির্যাতিত মুসলমানদের যথাসাধ্য আশ্রয় দিতেন। মক্কা বিজয়ের কিছু দিন পর তিনি সপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। মক্কা বিজয়ের যুদ্ধে অংশ নেন। হোনায়নের যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে একটি বাহনে আরোহী ছিলেন। হাওায়াজীন গোত্রের তীরন্দাজদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা দিগি¦দিক হারিয়ে ফেলেছিলেন। নবীজি (সা) তাঁর চাচা আব্বাস (রা)-কে কঠিনভাবে আওয়াজ দেয়ার নির্দেশ দিলে তিনি গর্জন করে বলতে থাকেন : “আইনা আসহাবুস সুমরা”- তীরন্দাজরা কোথায়! যা যুদ্ধের গতিকে বদলিয়ে দিয়েছিল।

হযরত আব্বাস (রা) ৩২ হিজরির রজব মাসে ৮৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হযরত উসমান (রা) তাঁর জানাজার ইমামতি করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) তাঁর সম্মানিত পিতার লাশ কবরে রাখেন। মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

হাদিস শরীফের তাফসীর

‘ঈমানের প্রকৃত স্বাদ’ বলতে আমরা কী বুঝি?
ইসলামের বিশাল প্রাসাদ ঈমানের বুনিয়াদের ওপর এভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বিশাল বটবৃক্ষ যেমন তার মূল ও শিকড়ের ওপর দণ্ডায়মান। ইসলামের বিস্তৃত শাখা প্রশাখা তথা যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে এক পাল্লায় রাখলে যে ওজন ও মূল্য বহন করে, ঈমান একাই সব কিছুর চেয়ে বেশি ভারী ও বেশি মূল্য বহন করে। এই ঈমান গ্রহণকারী একজন কৃতদাস ও তাঁর আল্লাহর নিকট সমগ্র পৃথিবী বিখ্যাত কোন রাজা মহারাজা সম্পদের মালিক এর চেয়ে অনেক বেশি বা অনেক মূল্যবান। যে ঈমানই একজন কাফির জাহান্নামীকে জান্নাতের অন্তর্ভুক্ত করবে। একজন ব্যক্তির চূড়ান্ত সফলতা ও বিফলতা প্রকৃতপক্ষে ঈমানের ওপর ফয়সালা হয়। নবীদের দাওয়াতের মূল বিষয় ঈমান। আল্লাহতায়ালার নিকট থেকে তাঁর সকল অহি ও কিতাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ঈমান। এ ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত না হলে ব্যক্তি কোনো নেক আমলের কোনো মূল্য বহন করে না। এ ঈমানই ব্যক্তিকে আল্লাহতালার প্রিয়জন বানায়। তার জীবনের নিরাপত্তা সম্মান আল্লাহর জিম্মায় থাকে। পৃথিবীর সমস্ত শয়তানি শক্তি ঈমানের শত্রু। মুমিনের কারণে পৃথিবীর জীবনে শতশত কারবালা সৃষ্টি হয়েছে। কুরআন সাক্ষ্য দিয়ে বলছে তাদের ওপর অত্যাচার ও জুলুমের কারণ ঈমান ছাড়া আর কিছুই ছিল নাÑ “শপথ দুর্গময় আকাশমণ্ডলীর। সে কঠিন দিনের, যে দিবসের ওয়াদা করা হয়েছে। শপথ তাদের যারা কিয়ামতকে অবলোকন করবে আর তার শপথ সে কঠিন দিবসে যা কিছু দেখানো হবে। ধ্বংস তাদের জন্য যারা বিশ্বাসীদেরকে আগুনে পুড়ে মারার জন্য গর্ত খনন করছিল তাতে প্রজ্বলিত করল দাউ দাউ অনল। মুমিনদের নিক্ষেপ করা হচ্ছিল সে প্রজ্বলিত অনলকুণ্ডে আর তারা সে গর্তের মুখে তামাশা দেখছিল। ঈমানদারদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণের একটিই কারণ, তারা তো মহান পরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালা যিনি সপ্রশংসিত সে মহান প্রভুর ওপর বিশ্বাস ছাড়া আর কোনো অপরাধ করেনি।” (সূরা বুরুজ : ১-৪)

উপরের আয়াতগুলোতে ঈমানের কারণে নির্যাতনের একটি জীবন্ত চিত্র আল্লাহর অহিতে অঙ্কিত হয়েছে। কুরআনুল কারিম বিভিন্ন সূরায় অনুরূপ চিত্র আরও মর্মস্পর্শীভাবেও এঁকেছেন। এগুলো কোনো সাহিত্যিকের কল্পনার বুনুনকর্ম নয়। এগুলো মহাকালে ঘটে যাওয়া মহাসত্যের মহাদলিল।

আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে এত নিযার্তন, এত নিষ্ঠুরতা, এত লোমহর্ষক বর্বরতা সহ্য করে ঈমানের ওপর অটল ও দৃঢ়কদমে দাঁড়িয়ে থাকতে কিসে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল? শরীরের এক একটি অংশ বিচ্ছেদ করার পর, হাড্ডি থেকে গোশতকে লোহার চিরুনি দিয়ে তুলে নেয়ার পরও তাদের কলিজা থেকে ঈমানকে পৃথক করা যায়নি। এটি সহজ বিষয় নয়। জ্বলন্ত কয়লার ওপর জীবন্ত বেলালকে শুইয়ে পাথর চাপা দেয়া হয়েছে শরীরের চর্বি গলে গলে কয়লা দেহে ঢুকে পড়েছে, রক্ত ও চর্বিতে আগুন নিভে গিয়েছে। সে মর্মান্তিক মুহূর্তেও হযরত বেলাল (রা) ঈমান থেকে এক তিল পরিমাণ দূরে সরেননি। অচেতন অবস্থায় তিনি অস্পষ্ট স্বরে বলছিলেন, ‘আহাদুন আহাদুন’। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সাহাবীদের ও পরবর্তীদের জীবনে রয়েছে ও গ্রন্থাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সে মজলুম মুসলমানেরা ঈমানের মধ্যে কী রহস্যজনক এক মজা খুঁজে পেয়েছিলেন। পার্থিব কোনো আনন্দ বা অসহ্য কোন যাতনা তাদেরকে ঈমানের স্বাদ আস্বাধনে এক মুহূর্তের জন্য বিরত রাখতে পারেনি। তাদের ঈমানের ওপর দৃঢ়তা পৃথিবীর সকল আশ্চর্যকে হার মানায়, সকল হৃদয়কে হতবাক করে, সকল জবানকে ভাষাহীন করে দেয়। অমানবিক অত্যাচার ও জুলুমের হাজার ক্ষত নিজ দেহে ধারণ করে সহাস্য বদনে বিপ্লবীদের নয়ন নিধি সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ ফাঁসির রজ্জু পরানোর সময় নিজ হাতে তা পরেছিলেন। অগণিত সাংবাদিকের ক্যামেরা চঞ্চল হলেও সে দৃশ্যে তারা সকলে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “জীবন ও মৃত্যুর রহস্য সম্পর্কে তোমরা আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে। এ রোমঞ্চকর মুহূর্তটির জন্য আমি অবর্ণনীয় জুলুম বরদাশত করে আসছি বছরের পর বছর।”

আমরা যারা ঈমানদার বলে নিজেদেরকে ঘোষণা দিয়েছি আমরা কি তাদের মতো ঈমানের স্বাদ ও মজা পেয়েছি? আল্লাহতায়ালা তাদের মতো ঈমান আনার আহবান করেছেন কুরআনে পাকে এভাবে- “যখন তাদেরকে বলা হলো, আর সব লোক যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সে সব লোকের মতো ত্যাগ কুরবানির সাথে ঈমান আন। তারা বলে আমরা কি বোকাদের মতো ঈমান আনব? হায়, এরা যে প্রকৃতপক্ষে বোকা সে ব্যাপারে তারা অজ্ঞতার তিমিরে।” (সূরা বাকারা : ১৩)

আমাদেরকে তাদের মতোই ঈমান আনতে হবে, আল্লাহতায়ালা যাদের ঈমান কবুল করেছেন। মুখে কতগুলো বুলি আর ঈমানের কথাসমূহ উচ্চারণের নাম প্রকৃত ঈমান নয়। আমাদেরকে সে লোকদের মত ঈমান আনতে হবে যাদের মাথার ওপর করাত দিয়ে চিরে দ্বিখণ্ডিত করার পরও ঈমান অখণ্ড ছিল। এক চুল পরিমাণ বিশ্বাস টলেনি যাদের। তাদের ঈমান সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেন- “তাদের ক্বালবের জমিনের ওপর ঈমানের পাহাড় অটলভাবে দাঁড়িয়েছিল।” আলোচ্য হাদিসের মধ্যে নবীয়ে করীম (সা) ঐ ঈমান কিভাবে হাসিল সম্ভব তা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সে দুর্বল ঈমান লাভের ও তার রহস্যপূর্ণ ও অমৃতের স্বাদ গ্রহণের তিনটি শর্ত:

নিম্নে হাদিসের আলোকে তা বর্ণিত হলো-
১. আল্লাহতায়ালই এক মাত্র ‘রব’। যিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন আল্লাহকে রব হিসেবে। এ ‘রব’ শব্দটি কুরআনে পাকে গুরুত্বের সাথে ও বহুমাত্রিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে :

ক.প্রতিপালক অর্থে : “প্রশংসা শুধু আল্লাহতায়ালার জন্য যিনি সারা জাহানের পালনকর্তা।” (সূরা ফাতিহা : ১)
খ.মালিক ও মনিব অর্থে : “তিনি তোমাদের প্রভু। তাঁরই নিকট তোমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সূরা হুদ : ৩৪)
গ.যার আনুগত্য করা হয় সে অর্থে: “তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও আনুগত্যের হকদার বানাবে না।” (আলে ইমরান: ৬৩)
ঘ.জিম্মাদার ও তত্ত্বাবধায়ক অর্থে : “ইউসুফ (আ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই! তিনি আমার রব যিনি আমাকে ভালো রেখেছেন।” (সূরা ইউসুফ : ২৩)

রব হিসেবে আল্লাহতায়ালাকে গ্রহণ করার অর্থ তিনি একমাত্র প্রতিপালক, তিনি মালিক ও প্রভু তিনি তত্ত্বাবধানকারী ও তিনি একমাত্র আনুগত্য পাওয়ার হকদার। রবুবিয়াতের পূর্ণ ব্যাখ্যা সহকারে ঈমান আনা একান্ত জরুরি। পৃথিবী বিপর্যয় সৃষ্টিকারী শক্তিগুলো যুগে যুগে নিজদেরকে “আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব” বলে দাবি করেছে। অগণিত মানব তাদের রবুবিয়াত মেনেও নিচ্ছে। আজকের বিশ্বে নিজদেরকে যারা Super power; the mightiest man of the whole world ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলছে লালন ও পালনকারী সেজে আর বিশ্ববাসীর আনুগত্য ও বশ্যতা দাবি করছে। এরাই ফেরাউন ও নমরুদের উত্তরসূরি। নবীগণ এদের মত সকল তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে সংঘাতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিলেন এদের মিথ্যা রবুবিয়াতের তখত তাউস। ঈমানের স্বাদ যারা পেয়েছিলেন যে মানুষগুলো আল্লাহতায়ালাকে রব বলে শুধু ঘোষণা দেননি বরং তাতে সন্তুষ্ট চিত্ত ছিলেন। তারা তাদের জীবন যাপনের ওপর উপকরণের জন্য দিনের পর দিন উপবাস থেকে একমাত্র মহান প্রভুর নিকট হাত পেতেছেন। শত্রুর হাতে বন্দী হয়েও ফাঁসির রজ্জু গলায় পরার মুহূর্তেও তাঁরা জীবন ভিক্ষা চাননি জালেমের কাছে। আল্লাহর ওপর ঈমানের কসম খেয়ে শির উঁচু করে ঘোষণা দিয়েছিলেন- “হায়াত আওর মাউত কি ফায়সালা জমিন পর নেহি, উয় আসমান পর হোতা হ্যায়।”

তাই নবীজি (সা)-এর হাদিস এই পয়গাম নিয়ে এসেছে- আল্লাহতায়ালার রবুবিয়াতের ওপর যারা সন্তুষ্ট তারা আলোতে অন্ধকারে, জীবনে-মরণে, সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায়, আল্লাহতে রাজি থাকবে। এক লহমার জন্যও নিরাশ হবে না, কান দেবে না কারো আশ্বাসে বা কারো হুমকিতে। তবেই তারা ইমানের স্বাদ খুঁজে পাবে।

২. দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে : “ইসলামী জীবন বিধান গ্রহণ করে তারা পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট”। তারা ইসলামকে আনুষ্ঠানিক একটি সাধারণ ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেনি বরং গ্রহণ করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে। ইসলাম প্রচলিত অর্থে কোন ধর্ম নয়। Islam is a complete comprehensive and rational code of life. তা পূর্ণাঙ্গ বিস্তৃতি ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি জীবনবিধান।

কুরআনুল করিমে এ দীন শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে :
ক.জীবনবিধান অর্থে দ্বীন : “তারা কি আল্লাহরতায়ালার তৈরি বিধান ছাড়া অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা তালাশ করছে, অথচ আকাশ ও জমিনের সবকিছু ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহতায়ালার কানুনের নিকট আত্মসমর্পণ করছে এবং তারই নিকট সবাইকে ফিরে যেতে হবে। (সূরা আলে ইমরান : ৮৩)
খ.আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ অর্থে দ্বীন : “সাবধান! আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য।” (সূরা জুমার : ৩)
গ.সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব অর্থে দ্বীন : “হুকুম দেয়ার অধিকার আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। তাঁর নির্দেশ তিনি ব্যতীত কারো দাসত্ব গ্রহণ করা যাবে না। আর এটাই সঠিক দ্বীন।” (সূরা ইউসুফ : ৪০)
ঘ.প্রতিফল দিবস তথা সফলতার ও ব্যর্থতার চূড়ান্ত ফায়সালা অর্থে দ্বীন : “যিনি প্রতিফল দিবসের মালিক।” (সূরা ফাতিহা : ৩)

উপরের আয়াতসমূহ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, মানুষের জীবন চলার বিধান সার্বভৌমত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা ও বন্দেগির সকল পর্যায় এ শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে নিহিত রয়েছে। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন শুধু একটি- ইসলাম। তিনি জীবনের কোনো অংশে ইসলামী বিধান ছাড়া আর কোনো আচরণ বা পদ্ধতির সামান্য অংশও গ্রহণ করবেন না। “আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মকবুল দ্বীন।”

দ্বীন হিসেবে ইসলাম এক ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়ের নাম। তা মানবজীবনের সকল দিক বিভাগ ব্যক্তিগত, পারিবারিক সামজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, তামুদ্দনিক এবং বৈশ্বিক সর্বত্র বিস্তৃত। পৃথিবীতে বসবাসের সূচনা হয়েছিল আবুল বাশার আদম (আ) হতে। তাঁর ওপর আল্লাহতায়ালার বিধান নাজিল থেকে ইসলামের যে বিকাশ শুরু হয়েছিল সাইয়েদেনা মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে শান্তিময় জীবন যাপনের বিধিবিধান হিসেবে আল্লাহর আখেরি কিতাব চূড়ান্ত কুরআন বলেছেন, “আজ আমি ইসলামী দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের জন্য নাজিল হওয়া অহির ধারা পরিসমাপ্তি করলাম আর একমাত্র ইসলামকে তোমাদের সকলের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম।”

এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অতিক্রম করেছে পৃথিবীর গণ্ডি। নিঃসীম নীলিমায় প্রথম নাজিলে উড়িয়ে দিয়েছে বিজয় কেতন। সে অহঙ্কারী মানুষের পক্ষে সকল মানুষের সকল বিষয়ে অনাদিকালের জন্য নির্ভুল কল্যাণপ্রদ ও ভারসাম্যময় হয় এবং পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান বা দ্বীন রচনা করা চিন্তারও অগম্য বিষয়। সকলের জন্য সকল সমস্যার বিধান রচনা করা দূরের কথা একটি মানুষের একটি দিনের চলার বিধান তৈরি করা আদৌও কি সম্ভব? এক ঘণ্টা পরে নিজ জীবনে কী ঘটবে অথবা পৃথিবীতে কোন বিপর্যয় আসছে যে বলতে পারে না তার পক্ষে বিধান দেয়া কী করে সম্ভব হতে পারে? প্রত্যেকটি সৃষ্টির কী প্রয়োজন? ক্ষুদ্র বৃহৎ কে কী অবস্থায় রয়েছে, কার আকুতি কী? এমনিতর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে যিনি জ্ঞাত এমন সত্তা ছাড়া অহি প্রণয়ন কি সম্ভব হতে পারে? যার নিজেরও কিছু প্রয়োজন রয়েছে, নিজের সাথে রয়েছে রক্তের সম্পর্ক এমন কেউ কি নিরপেক্ষতা বজায় বাখতে পারে? তাই আমরা বলতে পারি ভবিষ্যতের জ্ঞান রয়েছে বর্তমানের মত, প্রত্যেকটি সৃষ্টির কী প্রয়োজন, কিসে তার ওপর ভালো বা মন্দ এ ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞানের অধিকারী-আর যিনি নিজে প্রয়োজনের ঊর্ধে যিনি সামাদ অর্থাৎ যার কোন কিছুর কোন প্রকার চাহিদা নেই, তিনি মহান স্রষ্টা।

আমরা জানি মানুষ আল্লাহতায়ালার নাজিলকৃত এ ইসলামী দ্বীনকে বাদ দিয়ে নিজেরা যখনই বিধান বানাতে চেষ্টা করেছে Super power; the mightest man of the whole world-এর নামে তখনই বিশ্বের এক একটি অঞ্চলে নেমে এসেছে বিপর্যয় আর মহা বিপর্যয়। সমস্ত মানব গড়া মতবাদ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আজ জাদুঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানব মস্তিষ্ক আর কোন নতুন দ্বীন জন্ম দিতেও পারছে না। কতগুলো বিকলাঙ্গ, অন্ধ, খন্জ, বধির, বোবা ও রুগ্ণ সন্তানের নামে প্রসব করে পৃথিবী আজ যেন প্রজনন ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর জ্ঞানীগণ আবার ইসলামকে সমস্যার সমাধান মনে করতে শুরু করেছে। দার্শনিক বার্ট্রার্ন্ড রাসেল বলেন “Islam is a complete comprehensive and rational code of life”.

“একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে ইসলাম বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামের বিজয় আজ অনিবার্য।” এর প্রয়োজনীয়তা ও অনিবার্যতাকে কোন অত্যাচার, জুলুম, কামান-গোলা ও ক্ষেপণাস্ত্র এবং মারণাস্ত্র দিয়ে স্তব্ধ করা যাবে না। ইসলাম ছাড়া আর যত দ্বীন পৃথিবীতে আছে- সেগুলো মানবগড়া, ভারসাম্যহীন ও খণ্ডিত। সেগুলো হয় রাজনৈতিক নতুবা অর্থনৈতিক মতবাদ। সম্পূর্ণ জীবন নিয়ে এগুলো রচিত হয়নি। এগুলো পরিত্যাজ্য ও ব্যর্থ পরাশক্তির জনবল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সমরাস্ত্র মোতায়েন করেও এর মধ্যে প্রাণ স্পন্দন সম্ভব হচ্ছে না।

হাদিসের শেষাংশে উদ্ধৃত হয়েছে- ঈমানের মজা তারাই পেয়েছে যারা মুহাম্মদ (সা)-কে নবী ও রাসূল হিসেবে পেয়ে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। তার আনীত আদর্শকেই একমাত্র পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর মাধ্যমে নবুয়ত ও রিসালাত খতম করে দিয়েছে। সকল নবী রাসেেূলক একটি নিদিষ্ট জনবসতির জন্য পাঠানো হয়েছিল। বাইরে তাদের নবুওয়াতের দাওয়াত প্রদানের অনুমতি ছিল না। নবুওয়াতের ইতিহাসের একমাত্র ব্যতিক্রম মুহাম্মদ (সা)। তিনি কোন এলাকার বা আঞ্চলিক নবী নন তিনি আলমি তথা বিশ্বনবী। তার নবুওয়াতের কোন চিহ্নিত সীমানা নেই ও নেই কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ। তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য আর অনাদিকালের জন্য রাসূল। কুরআন বলছে, “বল হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের সকলের জন্যে রাসূল হয়ে এসেছি।” (সূরা আরাফ : ১৫৮)

কুরআন বলছে- “আখেরি রাসূল তোমাদের জন্যে যা এনেছেন বিনাশর্তে গ্রহণ কর, আর তা থেকে বিরত থেকে থাক যা তিনি নিষেধ করেছেন।” (সূরা হাশর : ৭)

উপসংহার
একজন মুমিনের ঈমানের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে, এ হাদিস তা বুঝার এক মানদণ্ড। যে মুমিন সত্যিকারার্থে ঈমান এনেছে গোটা পৃথিবী সবকিছু ঈমানের মোকাবেলায় তার কাছে একটি পাখির ঝরা পালকের চেয়ে কমমূল্য বহন করে। আর ঈমান থেকে চ্যুত করার সমস্ত অত্যাচার ও জুলুম এবং নিপীড়নের তাবৎ হাতিয়ার তার নিকট এমন সাধারণ ও মামুলি বিষয় যেন লোহার কঠিন দণ্ডের ওপর মাছির ব্যর্থ আক্রমণ। এমন সুস্থ ও নিরোগ ঈমান শুধু কতগুলো কথা উচ্চারণ এর মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয় ৃনয় পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অজ্ঞদের ঈমানের মিথ্যা আস্ফালনে।
কুরআন বলছে তারাই মুমিন- “সত্যিকারার্থে তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং তাতে কোন প্রকার সন্দেহ করেনি আর সংগ্রাম করেছে জান ও মাল দিয়ে।” (সূরা হুজরাত : ১৫)

এ সত্যিকার মুমিনদেরকে ঈমানের অমৃত স্বাদ পেতে হলে হাদিসে রাসূলের তিনটি শর্ত প্রণিধানযোগ্য-
এক : আল্লাহর রবুবিয়াতের ওপর অটল আস্থা ও তাতে সন্তুষ্ট হওয়া।
দুই : দ্বীন হিসেবে ইসলামকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে চলার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করা এবং সমস্ত পৃথিবীর চাকচিক্যপূর্ণ মিথ্যা ও মানবগড়া সকল মত ও পথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মুহাম্মদ (সা) এর রিসালতের সাক্ষ্য দান ও সমস্ত মহান ব্যক্তি এমনকি পূর্বের নবীদেরকে ও তাঁর মোকাবেলায় পেশ করার সুযোগ নেই বরং তা হবে ধৃষ্টতার নামান্তর।
তিন : জীবনের প্রতিটি কদমে তার সুন্নাতকে এভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে জন্মান্ধ যেমন করে চক্ষুষ্মানের লাঠি শক্তহাতে ধরে পথ চলে।

হে প্রভু! আপনাকে একমাত্র রব, মুহাম্মদ (সা) কে শেষ ও চূড়ান্ত রাসূল এবং ইসলামকে শুধু আল্লাহর মনোনীত দ্বীন হিসেবে আমাদের জন্যে যথেষ্ট বানাও।