মানুষ মহান আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এ মানুষকে কেন্দ্র করেই সমগ্র সৃষ্টিজগতের সকল আয়োজন। আধুনিককালে মানুষের জীবন কিভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ এ মানুষের উন্নয়ন সাধন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন যথার্থ কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়নে কী কী নির্দেশনা দিয়েছে তা এ প্রবন্ধে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের পরিচয়, এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জ্ঞান অর্জন, জীবিকা অর্জন, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইসলামের গুরুত্বারোপ ও কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ বিষয়ে অত্র প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে পরকালীন চেতনা ও নৈতিকতার গুরুত্বকে দলিলসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধের শেষাংশে নৈতিক উন্নয়নে ইসলামের নির্দেশনাসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধটি মূলত কুরআন ও হাদিসের বর্ণনাভিত্তিক একটি প্রাথমিক উপস্থাপনা।
মানবসম্পদ উন্নয় আধুনিক উন্নয়ন চিন্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ধারণা। বিশ শতকের শেষ দশকে এ ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে। বর্তমানে উন্নয়ন চিন্তার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যে উন্নয়নের কথাই বলা হোক, সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবসম্পদ। একে ঘিরে এবং এর জন্যই সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টেকসই উন্নয়ন, সমন্বিত উন্নয়ন ধারণা, সামগ্রিক উন্নতি বা সর্বাত্মক সুষম উন্নয়ন, সকল ক্ষেত্রে মানুষের সুখ-সুবিধাই মূল বিবেচ্য হয়ে থাকে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক বা পরিবেশগত কোনো সুবিধা গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমাান উন্নয়ন ধারায় প্রথমে তাই মানবসম্পদ উন্ননে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে আবশ্যিক বলে গণ্য করা হয়। ইসলাম গোড়া থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম মানবকে সত্যিকারার্থে শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে এবং এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থাসমূহ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাস্তব উদ্যোগে গ্রহণ করেছে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটির বিকাশ ও বিস্তারে যে পরিমাণ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে এবং গুরুত্ব প্রদানের প্রেক্ষাপটে যে ফল লাভ হচ্ছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। এতে মানুষের বৈষয়িক উন্নয়ন কিছুটা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা বস্তুগত অর্জনের কাছে প্রতিনিয়ত মার খেয়ে যাচ্ছে। মানবিক বিপর্যয়ের চালচিত্র প্রতিদিনই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে, যা মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এমতাবস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের ভূমিকা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন একান্ত আবশ্যক। এ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন মানবসম্পদ উন্নয়নে আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা এবং সফলভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নের পথনির্দেশ করবে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচিতি : উন্নয়ন একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যা সমগ্র সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে একটি সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌত কাঠামো, পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ব্যবস্থা ও জীবন ধারণ পদ্ধতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়। “Human Development as a process of enlarging people’s choice. It placed equal emphasis on the formation of human capabilities (through investing in people) and on the use of those capabilities (through creating a participatory for income and employment growth.”–UNES CD for Asia and the Pacific, UNDP, Socio-Cultural Impact of Human Rescores Interpret, 1994, p8”
উন্নয়ন একটি ব্যাপক ধারণা, যা একটি সমাজকে বর্তমান অবস্থান থেকে অধিকতর কাম্য অবস্থানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে এবং এই কাম্য লক্ষ্যটি নির্ধারিত হয় ঐ সমাজের জনগণের ইতিহাস অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে। ‘‘মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিতে আমলাতন্ত্রের একটি পর্যালোচনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, সংখ্যা ৬৮, অক্টোবর ২০০০, পৃ. ৫৫’’। উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। এটি একটি পথমাত্র, চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। যে উন্নয়নে মানুষের জীবন উন্নত হয় না বা যাতে মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না, সে উন্নয়ন উন্নয়নই নয়। এ বোধই মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার জনক, যার মূল কথা মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। ‘সেলিম জাহান, অর্থনীতির কড়চা, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬, পৃ. ১০’’।
উন্নয়ন সম্পর্কিত নতুন এ ধারণাটির উদ্ভবের ফলে মানবিক দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে। বৈশ্বিকরণ প্রক্রিয়া জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়ার সময়ও স্থিতিশীল ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের সাথে মানব-উন্নয়নকে আবশ্যিকভাবে যুক্ত করা হয়। কারণ মানব উন্নয়ন ধারণা সৃষ্টিশীলতা ও বিকাশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ‘‘এজাজুল হক চৌধুরী, মানবিক উন্নয়ন, ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৯, পৃ. ১১’’। মানব উন্নয়ন ব্যাপক জনগণের পছন্দভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। এটি মানবসক্ষমতার ওপর ভিত্তিশীর (জনগণের বিনিযোগের মাধ্যমে) এবং এসব সক্ষমতা সমভাবে ব্যবহৃত হয় (আয় এবং কর্মপ্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অংশগ্রহণমুখী পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন। ”Human Development as a process of enlarging people’s choice. It placed equal emphasis on the formation of human capabilities (through investing in people) and on the use of those capabilities (through creating a participatory for income and employment growth.”–UNES CD for Asia and the Pacific, UNDP, Socio-Cultural Impact of Human Rescores Interpret, 1994, p8”’ মানব উন্নয়ন ধারণাটি বহুমাত্রিক ধারণার সমষ্টি। এর মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক, সর্বোপরি জীবনমান উন্নয়নকে বোঝায়।
১৯৯০ সলে ইউএনডিপি-র ”United Nations Development Program’ রিপোর্টে বলা হয়, মানব উন্নয়ন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা সমগ্র সম্পদের সম্প্রসারণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করে। ”’Human development process fascinating is the entire spectrum through which human capabilities are expanded and utilized.”–UNDP Report, 1990.”১৯৯১ সালে মানব উন্নয়নের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নির্দিষ্ট হয়। এগুলো হলো মানুষের উন্নয়ন, মানুষের ধারা উন্নয়ন এবং মানুষের জন্য উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সামাজিক কল্যাণে বিনিয়োগ করা। উন্নয়নের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও প্রয়োগ হলো মানুষের দ্বারা উন্নয়ন আর মানুষের দ্বারা উন্নয়ন হলো প্রতিটি মানুষের চাহিদা, আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ”a) Development of the people whine includes investment in education, health, nutrition and social well being as the people, b) Development by the people which implies full participatory development. c) Development for the people which specifies everyone’s needs and provides income and employment opportunities for all.–UNDP Report, 1991” ১৯৯২ সালে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা মানব উন্নয়ন সূচক নির্ধারিত হয়। সংক্ষেপে একে বলে এইচডিআই, এগুলোর মধ্যে জীবনের দীর্ঘ স্থায়িত্ব, দক্ষতা উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বা সরকারি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে আত্মকর্মসংস্থান অন্যতম। ”Human Development Index (HDI)–a) Longevity of life (b) Knowledge related to develop of skills and (c) Self employment or formal employment in a public or private enterprise.–UNDP Report, 1992”
সাধারণ কথায়, মানবসম্পদ উন্নয়নকে বলা হয়, People Centre Development অর্থাৎ উন্নয়নব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ মানবকেন্দ্রিক; মানুষ নিজেরা নিজেদের দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটাবে এবং নিজেরাই তার ফল ভোগ করবে। ‘‘ড. মো: নুরুল ইসলাম, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ঢাকা: তাসমিয়া পাবলিকেশন্স, ২০১০, পৃ. ১২৩’’ শিক্ষাবিদ-গবেষকগণের কেউ কেউ মানবসম্পদ উন্নয়নকে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখেছেন যা কর্ম-কৃতিত্ব (Job Performance) বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা বলেছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কর্ম-কৃতিত্ব উন্নয়ন বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে সংগঠিত শিক্ষা অভিজ্ঞতা। “Human Resource Development (HRD) as organized learning experience in a definite time period to increase the possibility of improving job performance growth.”–Leonard Nobler in Rafiqul Islam, ”Human Resource Development in Rural Development in Bangladesh, Dhaka : National Institute of Local Goverment 1990, p70”
মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের পদক্ষেপসমূহ : ইসলামে মানব উন্নয়ন আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূল বিষয়। ”Human Development remains the key issue of socio-economic development”–Mohammad Solaiman Tandal, Socio-Economic Development and Human Welfare, Development & Human Welfare, Rajshahi, 2000, p2. কুরআন মাজিদের মৌলিক বিষয় হলো মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মানব উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গঠন। এ উন্নয়নের জন্য ইসলাম মানুষের দৈহিক আকৃতিতে মানুষ হওয়ার সাথে সাথে মানবিক ঔদার্য ও মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টি হিসেবে মানুষ সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’লাই মানুষকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন’। ‘‘আল-কুরআন, ০৬ : ১৬৫,
তিনি অন্যত্র বলেছেন : নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি, তাদেরকে স্থলভাগে ও সাগরে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদেরকে পবিত্র জীবিকা দিয়েছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। ‘‘আল-কুরআন, ১৭ : ৭০’’। তবে মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহ তা’য়ালা স্থায়ী ও অক্ষয় করে দেননি। বরং মানুষের আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা ও না করার ওপর এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কেউ যদি আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশনা মেনে নিজের আচরণ ও মানসিকতা উন্নত করে তাহলে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ রাখতে পারবে। আর যদি এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তাহলে নীচ থেকে নীচতর স্তরে নেমে যাবে। ‘‘আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেছেন : নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সুন্দরতম করে সৃষ্টি করেছি। এরপর আমি তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়েছি’’। ‘আল-কুরআন, ৯৫ : ৪-৫’। মানুষের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণœ রাখার পথ হিসেবে আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন অনিবার্য করে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন চেষ্টা নৈতিকভাবে সকলের জন্য বিধিবদ্ধ উপায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবশ্যিক হয়েছে জ্ঞান অর্জন, হালাল জীবিকা উপার্জন ও গ্রহণ, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ, আখিরাতে সফলতা- ব্যর্থতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ এবং বিশেষভাবে নৈতিক উন্নয়ন।
জ্ঞানার্জন :
মুমিন হওয়ার জন্য জ্ঞানার্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ তাআলা প্রথম মানুষ আদম আ: কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম আ: এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কুরআন মজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নামসমূহ জানাও।’ ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে আদম! তুমি যাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’ এরপর যখন আদম তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তাআলা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয়ই আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালোভাবেই জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ছাড়া সকলেই সিজদা করল। ইবলিস অবাধ্য হল ও অহঙ্কার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। ’আল-কুরআন, ০২ : ৩১-৩৪’
রাসূলুল্লাহ সা. যখন রিসালাত লাভ করলেন তখন তাঁর ওপর প্রথম যে ওহি নাজিল হলো তাও জ্ঞানার্জন বিষয়ক। হিরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ সা. প্রথম ওহি লাভ করলেন, পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়–ন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। ‘ আল-কুরআন, ৯৬ : ১-৫’। জ্ঞানকে মর্যাদা ও কল্যাণের বাহন বর্ণনা করে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন।” ‘আল-কুরআন, ৫৮ : ১১’। অন্যত্র বলা হয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন। আর যাকে হিকমাত দেয়া হয় তাকে বিপুল কল্যাণ দান করা হয়। আর জ্ঞানীরা ছাড়া কেউ তো উপদেশ গ্রহণ করে না। ‘ আল-কুরআন, ০২ : ২৬৯’। আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষেরা! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। ‘আল-কুরআন, ৫৯ : ২’।
জ্ঞানের প্রতি আল্লাহ তাআলার এমন গুরুত্বারোপের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সা. জ্ঞান অর্জনকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিজন মুসলিমের ওপর ফরজ। ‘‘ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, তাহকিক : মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, অধ্যায়: ইফতিতাহুল কিতাব ফিল ঈমান ওয়া ফাযায়িলুস সাহাবাহ ওয়াল ইলম, অনুচ্ছেদ : ফাযলুল উলামা-ই ওয়াল হাছছি আলা তলাবিল ইলম, বৈরুত : দারুল ফিকর, তা-বি, হাদিস নং-২২৪; হাদিসটির উল্লিখিত অংশটুকু সনদ সহীহ; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানু ইবনু মাযাহ, হাদিস নং ২২৪’’।
জ্ঞানীকে তিনি নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরি আখ্যায়িত করে বলেছেন, আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দিনার বা দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার রেখে গেছেন শুধু জ্ঞান। তাই যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করেছে সে অর্জন করেছে উত্তরাধিকারের পুরো অংশ। ‘‘ইমাম আত-তিরমিজি, আস-সুনান, তাহকিক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির ও অন্যান্য, অধ্যায় : আল- ইলম, অনুচ্ছেদ : মা জাআ ফি ফাযলিল ফিকহি আলাল ইবাদাহ, বৈরুত : দারু ইহইয়াই তুরাছিল আরাবি, তা.বি, হাদিস নং- ২৬৮২; হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং- ২৬৮২’’। জ্ঞানার্জনের কাজকে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়েছে, সে আল্লাহর পথে রয়েছে, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে। ‘‘ইমাম আত-তিরমিজি, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-ইলম, অনুচ্ছেদ : ফাযলু তলাবিল ইলম, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ২৬৪৭; হাদিসটির সনদ যঈফ; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল- আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং- ২৬৪৭’’। এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়।
জীবিকা অর্জন :
আল্লাহ তাআলার ইবাদত যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কুরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি জিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে। ‘আল-কুরআন, ৬২ : ১০’। আবার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালা-হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এমন প্রবলভাবে যে, ইবাদত কবুল হবে কি না, ব্যক্তি জান্নাতে যাবে কি না তা একান্তভাবে জীবিকা উপার্জনের পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। ফলে ইসলামে একজন ব্যক্তি কেবল জীবিকাই উপার্জন করে না বরং হালাল উপায় অবলম্বন করে বৈধভাবে জীবিকা উপার্জন করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরজের পরে ফরজ। ‘‘ইমাম আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফি হুকুকিল আওলাদি….., বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হি., হাদিস নং- ৮৭৪১; হাদিসটির সনদ মুনকার এবং যঈফ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযুআহ ওয়া আছারুহাস সায়্যি ফিল উম্মাহ, রিয়াদ : দারুল মা’আরিফ, ১৪১২হি./ ১৯৯২ খ্রি. খ. ১৪, পৃ. ৩৪৮; হাদিস নং- ৬৬৪৫, ৩৮২৬’’। অর্থাৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদত করো। ‘ আল-কুরআন, ০২ : ১৭২’। আল্লাহর রাসূল সা. এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোঁটা রক্তের জন্য নরকই যথোপযুক্ত আবাস। ‘‘ ইমাম আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফি তিবিল মাত’আমি ওয়াল মালবাস ওয়া ইজতিনাবিল হারামি ওয়া ইত্তিকা-ইশ শুবহাত, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৫৭৬২; হাদিসটির সনদ সহীহ লি-গাইরিহি মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা’আরিফ, ৫ম সংস্করণ, খ. ২, পৃ. ১৫০; হাদিস নং- ১৭২৯’’।
স্বনির্ভরতা অর্জন :
ইসলামে কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকাকে সমর্থন করা হয়নি। ব্যক্তি নিজে উপার্জন করবে, নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করবে। অন্য কারো আয়ে ভাগ বসাবে না। রাসূলুল্লাহ সা. সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, পবিত্রতম উপার্জন হলো মানুষের নিজের হাতের পরিশ্রম এবং প্রত্যেক বিশুদ্ধ ব্যবসায় (এর উপার্জন)। ‘‘আলাউদ্দিন আল-মুত্তাকী, আল-হিন্দি, কানযুল উম্মাল, অধ্যায় : আল-বুয়ু, অনুচ্ছেদ: ফি ফাযায়িলিল কাসবিল হালাল, বৈরুত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৯৮৯ খ্রি., হাদিস নং-৯১৯৬; হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, আস-সিলসিলাতুল আহদাসিস সহীহাহ, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা’আরিফ, খ. ২, পৃ. ১৫৯; হাদিস নং- ৬০৭’’। স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য কাজ করতে হলে কেউ যেন তাতে দ্বিধা না করে, লজ্জাবোধ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য ইসলামের শ্রম ও শ্রমিককে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। নানাভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা শ্রম পছন্দ করেন। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যারা তোমাদের কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে, সে শ্রমিক তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যাদের কাছে এমন লোক আছে তাদেরকে যেন তা-ই খেতে দেয় যা তারা নিজেরা খায়, তাদেরকে যেন তা-ই পরতে দেয়, যা তারা নিজেরা পরে। তোমরা তাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ করতে বাধ্য করবে না। যদি তাদেরকে তোমরা কোনো কঠিন কাজ করতে দাও, তা হলে তোমরা তাদের সহযোগিতা করবে। ‘‘ইমাম আল-বুখারী,আস সহীহ, অধ্যায় : আল-ঈমান, অনুচ্ছেদ : আল-মাআসী মিন আমরিল জাহিলিয়্যাহ ওয়ালা ইউকফারু সহিবুহা বি-ইরতিকাবিহা বিশ-শিরক, বৈরুত: দারু ইবনি কাছির, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৭হি./১৯৮৭খ্রি. হাদিস নং-৩০’’।
শ্রমিককে যেন তার প্রাপ্য মজুরির জন্য নিয়োগকর্তার পেছনে ঘুরতে না হয় এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য নিয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর রাসূল সা. নির্দেশ দিয়েছেন, শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। ‘‘ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: আর-রূহুন, অনুচ্ছেদ : আজরিল উজারা, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২৪৪৩। হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানু ইবনি মাজাহ্, হাদিস নং- ২৪৪৩’’। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাফি’ ইবনু খাদিজ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. কে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম ও পবিত্রতম? তিনি বলেছেন, ব্যক্তির নিজের শ্রমের উপার্জন ও সৎ ব্যবসায়লব্ধ মুনাফা। ‘‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, তাহিক : শুঅন্ব আল-আরনাউত, বৈরুত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০হি./১৯৯৯ খ্রি. খ. ২৮, হাদিস নং-১৭২৬৫’’। হাদিসটির সনদ সহীহ গাইরিহি; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ১৬৮৮।
আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সা. নানাভাবে মানুষকে কাজ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি অনীহা তৈরির জন্য রাসূল সা. বলেছেন, নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আয-যাকাত, অনুচ্ছেদ: লা সদাকতা ইল্লা আন যহরি গিনা, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ১৩৬১। আল্লাহ তা’আলার হুকুম আর আল্লাহর রাসূলের এ নির্দেশনা মেনে ব্যক্তি যদি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে অনিবার্যরূপে তাঁর ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। এভাবে উন্নয়ন ঘটবে মানবের। অদক্ষ-অক্ষম বোঝার পরিবর্তে ব্যক্তি উন্নত সম্পদে পরিণত হবে।
কর্তব্য পালন :
ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, ইমাম বা নেতা, যিনি জনগণের ওপর দায়িত্ববান-তিনি তার অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বশীল- সে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ও সন্তান-সন্ততির। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর দাস ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এই সম্পদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কাজেই সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে (পরকালে আল্লাহর নিকট) জিজ্ঞাসিত হবে। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-আহকাম, অনুচ্ছেদ : কাওলুল্লাহি তাআলা আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৬৭১৭’’। ইসলাম একন্তভাবে মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে, কেউ কারো বোঝা বহন করবে না।
আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সরল-সঠিক পথে পরিচালিত হবে নিশ্চয়ই তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আর যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্যই। কেউ কারো কাজের দায় বহন করবে না। আর আমি রাসূল পাঠিয়ে সতর্ক করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেই না। ‘আল-কুরআন, ১৭ : ১৫’। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তিসত্তার উন্নতি বিধান করে।
যোগ্যতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধি :
ইসলাম মানুষে মানুষে মানবিক কোন ব্যবধান বা বৈষম্য স্বীকার করেনি। মানবিক মর্যাদায় সাধারণভাবে সকলকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। মানুষের উৎস ও বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন সে ব্যক্তি থেকে তার জোড়া, আর তাদের দুজন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অন্যের নিকট কিছু চাও। আর তোমরা আত্মীয়দের (হক আদায় ও সম্পর্ক অটুট রাখার) ব্যাপারে সতর্ক হও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। ‘ আল-কুরআন, ০৪ : ১’
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। ‘ আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩’। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, হে মানবজাতি! সাবধান! নিশ্চয়ই তোমাদের রব একজন, তোমাদের পিতাও একজন। সতর্ক হও! কোন আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর ওপর সাদার কিংবা সাদার ওপর কালোর তাকওয়া ব্যতীত কোন মর্যাদা নেই। ‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ২৩৪৮৯; হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিছ সহীহাহ, রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা’আরিফ, হাদিস নং- ২৭০০’।
সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদিসে মানুষের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। ‘আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩’
পরকালীন সফলতা-ব্যর্থতার মাপকাঠি :
নিঃসন্দেহে মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রেরণা এর পরকালবিষয়ক মূল্যবোধ ও নীতিমালা। দুনিয়াতে একজন লোক যদি আর্থিক বা শারীরিক কিংবা সামাজিক দিক থেকে গ্রহণীয় হয় অথবা কেউ যদি সকল দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য হয় তাহলে দুনিয়ার বিচারে লোকটির জীবন সফল হয়েছে বা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। কিন্তু আখিরাতে ব্যক্তির সফলতা নির্ভর করে একান্তভাবে ব্যক্তির সঠিক বিশ্বাস, সৎকর্ম, সৎচিন্তা ও সৎ জীবনযাপনের ওপর। এর অর্থ হল ব্যক্তি যদি সমাজের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বা সমাজে সম্মানিত হওয়ার জন্য এমন কোন কাজ করে ইসলামের দৃষ্টিতে যা সম্মানজনক নয় তাহলে আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না। আবার বাহ্যত অসম্মানজনক বা নিপীড়নমূলক প্রমাণ হলেও আখিরাতে হয়তো কাজটি অত্যন্ত সম্মানের হতে পারে। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দুনিয়ায় লাভ-লোকসানের বিবেচনা ছাড়া একজন মানুষ আখিরাতে সফল হওয়ার জন্য ভেতরে-বাহিরে সৎ জীবন-যাপন করার চেষ্টা করে। কাউকে দেখানোর কারো মনোতুষ্টির আকাক্সক্ষা সে একেবারেই পোষণ করে না। সে দুনিয়াকে ততটুকুই গুরুত্ব প্রদান করে যতটুকু গুরুত্ব প্রদানের নির্দেশ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন : তোমরা কি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অত্যন্ত কম। ‘আল-কুরআন, ০৯ : ৩৮’। অন্যত্র তিনি বলেন, আখিরাত তো নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠতম পর্যায় এবং মর্যাদায় মহত্তম। ‘আল-কুরআন, ১৭ : ২১’। দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর, তবে তোমার দুনিয়ার অংশ ভুলে যেয়ো না। ‘আল-কুরআন, ২৮ : ৭৭’
আখিরাতের বিশ্বাস মানুষকে কেবল সৎকাজ করতেই উদ্বুদ্ধ করে না; বরং কাজটি একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে সৎকাজ করা হলে তা পুরস্কারযোগ্য হয় না। তাও শাস্তিযোগ্য আমলে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : কিয়ামাতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম যার বিচার হবে সে হবে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে- আমি তোমার পথে যুদ্ধ করেছি; এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্য যুদ্ধ করেছো যেনো তোমাকে বীরপুরুষ বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
দ্বিতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন আলেম। সে নিজে শিক্ষা লাভ করেছে, অপরকে তা শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময় কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, দুনিয়াতে আমি শিক্ষা লাভ করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করছি। আল্লাহ বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্য জ্ঞান অর্জন করেছিলে যেনো তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। কুরআন মাজিদ এ জন্য তেলাওয়াত করেছ যেনো তোমাকে কারি বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
তৃতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। আল্লাহ তাকে সচ্ছল করেছেন এবং বিপুল সম্পদ দিয়েছেন। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, যে পথে খরচ করলে তুমি খুশি হও, সে জাতীয় সব পথেই তোমার সন্তুষ্টির জন্য আশি খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনÑ তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমিতো এগুলো এ জন্য করেছো যেনো তোমাকে দানবীর বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। ‘‘ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, তাহকিক : মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, অধ্যায় : আল-ইমারাহ, অনুচ্ছেদ : মান কাতালা লির-রিয়াই ওয়াস সুমআতি ইসতাহাক্কান নার, বৈরুত : দারুল ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবিয়্যি, খ. ৩, হাদিস নং- ১৯০৫’’। আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছেন, কাজেই ধ্বংস সেই সকল সালাত আদায়কারীর জন্য, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় করে। ‘আল-কুরআন, ১০৭:৪-৬’। বস্তুত আখিরাতে সফলতা লাভই মুমিনের মূল লক্ষ্য। এ কারণে ইসলামে বিশ্বাসী একজন লোক দুনিয়ার সকল কাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেন। যে কারণে তার মধ্যে লোক দেখানোর বিষয়টি একেবারেই থাকে না। ফলে মানসিক দিক থেকে তিনি পরম উৎকর্ষ লাভ করতে সক্ষম হন। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা প্রেম তাকে কোনক্রমেই মন্দ কাজে নিয়োজিত করতে পারে না।
নৈতিক উন্নয়ন :
নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া যে কোন উন্নয়নই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাই রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আমি প্রেরিত হয়েছি সুমহান নৈতিক গুণাবলির পূর্ণতা সাধনের জন্য। ‘‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৮৯৫২। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিছ সহীহাহ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-৪৫’’। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন কাজ অধিকাংশ লোককে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি উত্তরে বলেছেন, কিয়ামাতের দিন যে জিনিসটি মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে তা হল ‘তাকওয়া ও উত্তম চরিত্র। ‘‘ইমাম তিরমিজি, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-বির ওয়াস সিলা, অনুচ্ছেদ : হুসনুল খুলুক, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২০০৪। হাদিসটির সনদ হাসান ; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং-২০০৪’’। রাসূলুল্লাহ সা. আরও বলেছেন, কিয়ামতের দিন যে জিনিসটি মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে তা হলো উত্তম চরিত্র। ‘‘ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-আদাব, অনুচ্ছেদ : ফি হুসনিল খুলুক, বৈরুত : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, তা.বি., খ. ৪, পৃ. ৪০০; হাদিস নং- ৪৮০১। হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ আবি দাউদ, হাদিস নং- ৪৭৯৯’’।
নাওয়াস ইবনে সামআন আল-আনসারী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে বির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘সুন্দর ব্যবহারই পুণ্য। ‘‘ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-বির ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাব, অনুচ্ছেদ : তাফসিরুল বিররি ওয়াল ইছমি, প্রাগুক্ত, খ. ৪, হাদিস নং- ২৫৫৩’’। তিনি সত্যিকার ও পূর্ণ মুমিন হিসেবে সে ব্যক্তিকেই অভিহিত করেছেন যার চরিত্র সুন্দর। তিনি বলেছেন, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। ‘‘ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায় : আস-সুন্নাহ, অনুচ্ছেদ : আদ-দলিলু আলা যিয়াদাতিল ঈমানি ওয়া নুকসানিহি, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ৩৫৪; হাদিস নং- ৪৬৮৪। হাদিসটির সনদ হাসানসহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানি আবি দাউদ, হাদিস নং-৪৬৮২’’।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ছিলাম। এমন সময় জনৈক আনসারী ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ রাস. কে সালাম করলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুমিনদের মধ্যে সর্বোত্তম কে? তিনি জবাব দিলেন, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যার চরিত্র সর্বোত্তম। ‘‘ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, অধ্যায় : আয-যুহদ, অনুচ্ছেদ : যিকরুল মাওতি ওয়াল ইসতিদাদ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৪২৫৯। হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিছ সহীহাহ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং ১৩৮৪’’। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা মুমিনের অসংখ্য নৈতিক গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন : নিশ্চয়ই মুমিনগণ সফল, যারা তাদের সালাতে ভীত ও বিনয়ী, যারা নিজেদেরকে অর্থহীন কাজ থেকে বিরত রাখে, যারা জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে কর্মতৎপর হয় এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ হিফাজত করে। ‘‘আল-কুরআন, ২৩: ১-৫’। বস্তুত ইসলাম যে বিষয়গুলোকে চরিত্রের সুন্দর দিক এবং অবশ্য অর্জনীয় গুণ হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলোকে আত্মার গুণ হিসেবে আত্মস্থ করা, নৈতিক বৈশিষ্ট্যের পরিণত করা এবং জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে স্বভাবতই মানুষ সম্পদে পরিণত হবে। যে সম্পদ দুনিয়ায় ব্যক্তির নিজের এবং অপরাপর সকলের কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করবে। প্রসঙ্গত নৈতিক উন্নয়নে ইসলামের কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করা যায়। যেমন,
১. কুরআন অধ্যয়ন : কুরআন হচ্ছে মুমিনের গাইড লাইন, জীবন বিধান। এর মধ্যে আল্লাহ তাআলা মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। সুন্দর চরিত্র গড়ে তোলার জন্য সবার আগে তাই কুরআন অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কুরআন অধ্যয়ন বলতে শুধু দেখে তেলাওয়াত বুঝায় না। বরং কুরআন অধ্যয়ন হলো এর মমার্থ, তাৎপর্য, তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে পড়া। শুধু দেখে দেখে কুরআন তেলাওয়াত করলে চরিত্রের ওপর তার সর্বব্যাপক প্রভাব পড়বে না। তাই সুন্দর চরিত্র গড়ে তুলতে হলে বুঝে কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। বুঝে কুরআন তেলাওয়াত না করে শুধু দেখে তেলাওয়াত করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হল, কুরআনকে চরিত্রে পরিণত করা। যেমন আল্লাহর রাসূল সা.-এর ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ যখন তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলেন, আয়িশা রা. বিনা দ্বিধায় বলে দিলেন। অর্থাৎ তোমরা যে কুরআন পড় সে কুরআনই তাঁর চরিত্র। ‘‘ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, তাহকিক : মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, অধ্যায় : হুসনুল খুলুক, অনুচ্ছেদ: মান দাআল্লাহ আন ইউসিনা খুলুকাহু, বৈরুত: দারুল বাশাইর আল-ইসলামিয়্যাহ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৯ হি./১৯৮৯ খ্রি., পৃ. ১১৬, হাদিস নং- ৩০৮। মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী হাদিসটির সনদ যঈফ বললেও মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী হাদিসটির সনদকে সহীহ লি-গাইরিহি বলেছেন; সহীহ আল-আদাবুল মুফরাদ লিল ইমাম আল-বুখারী, আল-জুবাইল, সৌদি আরব: দারুস সিদ্দীক, ১৪২১ হি., হাদিস নং- ২৩৪/৩০৮’’। একজন ব্যক্তি যদি দাবি আদায় করে আল-কুরআন তেলাওয়াত করেন, তাহলে কুরআনই তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর কুরআন মাজিদের শিক্ষা ব্যক্তির আত্মিক-আচরণিক ও বৈষয়িক উন্নতিতে সন্দেহাতীতভাবে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।
২. হাদিস অধ্যয়ন : আল-কুরআনের ব্যাখ্যা হলো হাদিস। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা যে কোনো হুকুমের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. সে মূলনীতি বাস্তবায়নের পথনির্দেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. নিজে থেকে কোনো কথা বা তত্ত্ব হাদিসের মাধ্যমে পেশ করেননি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন। আর তিনি (মুহাম্মাদ সা.) নিজে প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তাঁর নিকট প্রেরিত ওহি ছাড়া এগুলো আর কিছু নয়। ‘আল-কুরআন, ৫৩ : ৩-৪’’।
অন্যত্র সকল মানুষকে আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছেন। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন (অর্থাৎ যা করতে নির্দেশ দেন) তা গ্রহণ করো আর যা থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো। ‘‘আল-কুরআন, ৫৯ : ৭’’। তাই কুরআন মাজিদের বিধি ও অনুশাসন সঠিকভাবে মেনে চলার জন্য হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে। হাদিস অধ্যয়নও ব্যক্তির সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
৩. সত্য বলা : সত্য কথা বলা সুন্দর চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। সত্যবাদী হওয়া ছাড়া মুমিন হওয়া যায় না। ইসলাম সত্য, বাকী সবকিছু মিথ্যা। এখন কেউ যদি সত্যকে ধারণ করে সে ধারণ করবে ইসলামকে। আর কেউ যদি মিথ্যা বলার অভ্যাস করে, সে অবশ্যই ইসলাম বর্জনকারী হবে। ত্য মানুষকে সততার পথে পরিচালিত করে, আর মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- নিশ্চয়ই সত্য মানুষকে সততার পথ দেখায়, আর সততা জান্নাতের পথ দেখায় এমনকি কোন ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে আল্লাহর নিকট সিদ্দীক বা পরম সত্যবাদী হিসাবে লিখিত হয়, আর মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের পথ দেখায়, আর পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়, এমনকি কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে বলতে আল্লাহর নিকট কাযযাব বা চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে লিখিত হয়। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-আদাব, অনুচ্ছেদ: কাওলুল্লাহি তাআলা ইয়া আইয়ুহাল্লায়িনা আমানুত্তাকুল্লাহি ওয়া কুনু মাআস সহিকীন, ওয়ামা ইউনা আনিল কিযব, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৫৭৪৩’’। সত্যবাদীগণ আল্লাহ তাআলার পরম সন্তোষ ও সাফল্য লাভ করে থাকেন। যেমন, আল্লাহ বলেন, এটা তো সেদিন, যেদিন সত্যবাদীরা তাদের সত্যবাদিতার জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটাই তো মহাসাফল্য। ‘আল-কুরআন, ০৫ : ১১৯’। সত্য বলার অভ্যাস মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমন উন্নত করবে যে, সে সকলের বিশ্বাসভাজন হবে।
৪. সবর : সবর বা ধৈর্য ধারণ করা সুন্দর চরিত্রের একটি অনিবার্য দিক। ধৈর্যধারণ ছাড়া সুন্দর চরিত্র সার্থক ও অর্থবহ হয় না। সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে হলে তাই ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। কুরআন মাজিদে এসেছে, আল্লাহ তা’আলা ভালোবাসেন ধৈর্যশীলদের। ‘আল-কুরআন, ০৩ : ১৪৬’। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। ‘আল-কুরআন, ০২ : ১৫৩’।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, সবর বা ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত। ‘‘ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফাযায়িল শাহরি রমাযান, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৩৬০৮। হাদিসটির সনদ মুনকার মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিয যঈফা ওয়াল মাওযূআহ… প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৮৭১’’। তিনি আরো বলেছেন, সবর বা ধৈর্য ঈমানের অর্ধাংশ। ‘‘ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফিস সবরি আলাল মাসায়িব.. প্রাগুক্ত, হাদিস নং-৯৭১৬। হাদিসটির সনদ মুনকার মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিয যঈফা… প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৪৯৯’’। ধৈর্যশীল মানুষ নিঃসন্দেহে অনন্য গুণের অধিকারী। মানবকে সম্পদে পরিণত করার অন্যতম মৌলিক এ গুণটি অর্জন করা ইসলাম মুমিনের জন্য আবশ্যিক করেছে।
৫. কৃতজ্ঞতা : আল্লাহ তাআলা মানুষকে অসংখ্য নিআমাত দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এ নিআমতসমূহের বিনিময়ে তাঁর আদেশ পালন করা হলো কৃতজ্ঞা জানানো। আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চললে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে পারবে না। ফলে তার চরিত্র সুন্দর হবে। আল্লাহ তাঁর নিআমত আরো অধিকাহারে শোকরকারীকে দান করবেন। যেমন তিনি বলেছেন, যদি তোমরা শোকর করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের নিআমত বাড়িয়ে দেববো। ‘ আল-কুরআন, ১৪ : ৭’। যারা আল্লাহ তাআলার নিআমতের শোকর করে তাদের পক্ষেই অন্যান্যদের উপকার স্বীকার করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব। কৃতজ্ঞ মানুষকে আল্লাহ তাআলা যেমন ভালবাসেন তেমনি মানুষও কৃতজ্ঞ মানুষের জন্য আরও কিছু করার আগ্রহ পোষণ করে থাকেন। ইসলামের শিক্ষা মানুষকে কৃতজ্ঞা জ্ঞাপন অভ্যস্ত করে তোলে। এতে ব্যক্তি সর্বজনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে।
৬. আমানত সুরক্ষা : মানুষের নৈতিক উন্নয়ন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমানতদারিতা। আমানতদারিতা এক মহান নৈতিক গুণ। এ গুণ মানুষের কাছে মানুষকে বিশ্বাসভাজন ও ভালোবাসার পাত্র করে তোলে। মানুষ অবলীলায় তার কথা শোনে। তার কাছে তাদের সম্পদ এমনকি সম্মান পর্যন্ত আমানত রাখতে দ্বিধাবোধ করে না। ঈমান ও আমানতদারিতা অবিচ্ছেদ্য বিষয়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যার আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই। ‘‘ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফিল ঈফা-ই বিল উকুদ, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-৪৩৫৪; হাদিসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৩০০৪’’। আল্লাহ তাআলা আমানত সুরক্ষাকে ফরজ করেছেন। কুরআন মাজিদে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে দিতে। ‘ আল-কুরআন, ০৪ : ৫৮’। মানবসম্পদ উন্নয়নে গৃহীত বিপুল কর্মসূচি, বিস্তারিত কর্মশালা দিয়ে ব্যক্তির ভেতর আমানতদারিতা তৈরির নিরন্তর চেষ্টা পরিচালনা করতে দেখা যায়। অথচ ঈমান ও ইসলামের শিক্ষা ব্যক্তিকে আখিরাতে জবাবদিহিতার চেতনায় স্বভাবতই আমানতদার করে তোলে।
৭. ওয়াদা পালন : ওয়াদা এক ধরনের আমানত। কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়। ওয়াদা করলে তা পালন করতে হয়। আল্লাহ তাআলা ওয়াদালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। তিনি ওয়াদা পালনের আদেশ দিয়ে বলেন, মুমিনগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো। ‘আল-কুরআন, ০৫ : ০১’।